লাল পতাকায় ছেয়ে গেল সভার মাঠ

দুর্গাপুরের গ্যামন ব্রিজ লাগোয়া মাঠে শুক্রবার রাত পর্যন্ত মঞ্চ বাঁধার তদারকি করেছিলেন সিপিএম নেতারা। শনিবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ কুলটির সভাস্থলে দেখা গেল, জনা তিরিশ কর্মী নিয়ে চেয়ার সাজানোর কাজে নেমে পড়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মী সৈয়দ রাজা।

Advertisement

সুশান্ত বণিক ও সুব্রত সীট

কুলটি ও দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৪২
Share:

বাঁ দিকে, দুর্গাপুরের সভায় রাহুল গাঁধী এসে পৌঁছতে উল্লাস জনতার। ডান দিকে, সভা শেষে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে জনতার কাছে রাহুল। ছবি: বিকাশ মশান।

দুর্গাপুরের গ্যামন ব্রিজ লাগোয়া মাঠে শুক্রবার রাত পর্যন্ত মঞ্চ বাঁধার তদারকি করেছিলেন সিপিএম নেতারা। শনিবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ কুলটির সভাস্থলে দেখা গেল, জনা তিরিশ কর্মী নিয়ে চেয়ার সাজানোর কাজে নেমে পড়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মী সৈয়দ রাজা।

Advertisement

দৃশ্য ২: সকাল সওয়া ১০টা নাগাদ শ’চারেক লোকের মিছিল ঢুকছিল কুলটির সভাস্থলে। কাঁধে লাল পতাকা, মুখে কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ডাক। সিপিএম কর্মীরা গলা ফাটাচ্ছেন হাত চিহ্নে ভোট দেওয়ার জন্য! মিছিলের নেতৃত্বে থাকা সিপিএম নেতা সুজিত মুখোপাধ্যায় একগাল হেসে বলেন, ‘‘বাম-কংগ্রেস জোটের স্বার্থে আড়াই কিলোমিটার হেঁটে আমরা রাহুল গাঁধীর সভায় এলাম।’’

দৃশ্য ৩: ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে ১১টা ছুঁইছুঁই। মাথার উপরে গনগনে রোদ। সিপিএম-কংগ্রেসের লম্বা একটি যৌথ মিছিল সভাস্থলের দিকে চলেছে। প্রায় শেষের দিকে ক্লান্ত গলায় স্লোগান দিচ্ছেন সত্তোরর্ধ্ব গোপাল চক্রবর্তী। কংগ্রেস না সিপিএম, কোন দলের সমর্থক? উত্তর এল, ‘‘আজ এই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। বুকে পেসমেকার নিয়ে রাস্তায় নেমেছি, একটাই স্বপ্ন সত্যি করার জন্য।’’

Advertisement

খনি-শিল্পাঞ্চলে শনিবার কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীর সভাকে ঘিরে তৈরি হল এমন অজস্র দৃশ্য। কুলটি ও দুর্গাপুর, দুই জায়গাতেই কংগ্রেসের ব্যানার-ফেস্টুন ছাপিয়ে লাল পতাকায় ঢেকে গিয়েছিল সভাস্থল। রাহুল সেখানে পৌঁছতেই মঞ্চ থেকে নেমে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ে বেশি উৎসাহী দেখাল বাম নেতাদের। এ সব দেখে বোঝার উপায় ছিল না, কাদের আয়োজনে এই সভা।

সপ্তাহ তিনেক আগেও অবশ্য পরিস্থিতিটা এমন ছিল না। দুর্গাপুর পশ্চিম কেন্দ্রে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে বাম-কংগ্রেস টানাপড়েন হয়েছে যথেষ্টই। প্রথমে প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক বিপ্রেন্দু চক্রবর্তীর নাম জানানো হয়েছিল। পরে তৃণমূল ছেড়ে আসা কাউন্সিলর বিশ্বনাথ পাড়িয়ালকে কংগ্রেস এই আসনে প্রার্থী করার কথা জানায়। কংগ্রেস প্রার্থী দেবে, এই সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেও মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন বিপ্রেন্দুবাবু। যদিও তা পরে বাতিল হয়। কুলটিতেও কংগ্রেসকে আসন ছাড়া নিয়ে গোড়ায় অসন্তোষ ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের অন্দরে।

তবে প্রচার শুরু হয়ে যাওয়ার পরে কোনও পক্ষই আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। সিপিএম প্রার্থীর সমর্থনে দেওয়াল লিখেছেন কংগ্রেস কর্মীরা। কংগ্রেসের প্রার্থীকে নিয়ে পদযাত্রা করেছেন সিপিএম নেতা। আর রাহুল গাঁধীর সভায় যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আলিমুদ্দিন থেকে ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়ার পরে সভা সফল করতে কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে সিপিএমের নেতা-কর্মীদের। মাঠ পরিদর্শন থেকে মঞ্চ বাঁধার তদারকি, মাঠ ভরাতে বাস, গাড়ি করে লোক আনা— সব কিছুতেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন তাঁরা।

এ দিন কুলটির সভায় রাহুল এসে পৌঁছনোর আগে সিপিএমের শিক্ষক সংগঠনের প্রবীণ নেতা বংশীবদন রুজ ছড়া কাটছিলেন, ‘‘আ রাহা হ্যায় রাহুল। অব ভাগেগা তৃণমূল।’’ শুনে হাততালি দিয়ে উঠছেন কংগ্রেসের জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ সুভাষ রায়। এরই মধ্যে মঞ্চ থেকে এক কংগ্রেস নেতা আসানসোলের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ বংশোগোপাল চৌধুরীকে ‘কমরেড’ সম্বোধন করে সভামঞ্চে আহ্বান জানালেন। শুনে এক সিপিএম কর্মীর মন্তব্য, ‘‘কংগ্রেসিরাও এ বার কমরেড বলছেন!’’ সুভাষবাবু পাল্টা বলেন, ‘‘তোমাদেরও তো আমরা বন্দেমাতরম বলাচ্ছি।’’

দুপুর ১টা নাগাদ কুলটির আকাশে দেখে গেল রাহুল গাঁধীর কপ্টার। তা দেখে নিজেদের পতাকা ওড়াতে শুরু করলেন দু’দলের কর্মী-সমর্থকেরাই। রাহুল মঞ্চে ওঠার সময়ে তাঁর সঙ্গে মোবাইলে ছবি তুলতে দেখা গেল দুই সিপিএম প্রার্থী শিপ্রা মুখোপাধ্যায় ও জাহানারা খানকে। মঞ্চে বংশগোপালবাবুকে দেখে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরলেন রাহুল। হাততালি দিল গোটা মাঠ।

মিনিট কুড়ি বক্তব্য রাখার পরে বাম ও কংগ্রেসের প্রার্থীদের সঙ্গে খানিক ক্ষণ কথা বলেন রাহুল। কুলটির সভায় কংগ্রেস প্রার্থী অভিজিৎ আচার্য ও ইন্দ্রাণী মিশ্র ছাড়াও ছিলেন শিল্পাঞ্চলের চার সিপিএম প্রার্থী রুনু দত্ত, হেমন্ত প্রভাকর, শিপ্রা ও জাহানারা। এক সময়ে কংগ্রেসের সঙ্গে বহু রাজনৈতিক লড়াইয়ের সাক্ষী শিল্পাঞ্চলের প্রবীণ সিপিএম নেতা রুনুবাবু বলেন, ‘‘পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে হচ্ছে। পরে কী হবে জানি না।’’ আর সিপিএমের প্রবীণ নেতা, আসানসোল দক্ষিণের প্রার্থী হেমন্ত প্রভাকর বলেন, ‘‘মুহূর্তটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।’’ কুলটির পুরনো তৃণমূল নেতা সুব্রত সিংহ এ দিন এই সভায় কংগ্রেসে যোগ দিলেন।

দুর্গাপুরের মাঠেও লাল পতাকা দেখে হাত নাড়তে দেখা গিয়েছে রাহুল গাঁধীকে। বিকেল ৩টে ১০ নাগাদ হেলিকপ্টার থেকে নেমে মঞ্চের পিছন দিকে শহরের বাম ও কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মিনিট সাতেক আলোচনা সেরে নেন তিনি। সেখানে ছিলেন কংগ্রেসের দেবেশ চক্রবর্তী, সুদেব রায়, বংশীবদন কর্মকার, উমাপদ দাস, সিপিএমের বিপ্রেন্দু চক্রবর্তী, পঙ্কজ রায় সরকারেরা। তখন মাঠে প্রতীক্ষায় হাজার-হাজার মানুষ। বাইরে আরও অনেকে।

মঞ্চে উঠে দুর্গাপুর পশ্চিমের কংগ্রেস প্রার্থী বিশ্বনাথবাবু, দুর্গাপুর পূর্বের সিপিএম প্রার্থী সন্তোষ দেবরায়, পাণ্ডবেশ্বরের সিপিএম প্রার্থী গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় এবং গলসির ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী নন্দলাল পণ্ডিতের সঙ্গে নিজেই পরিচয় করেন রাহুল। বিশ্বনাথবাবু ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে শুরু করলে থামিয়ে দিয়ে বাংলায় বলতে বলেন। বক্তব্য শেষে রাহুলের পাশে গিয়ে বসেন বিশ্বনাথবাবু। রাহুল তাঁকে জানান, অধীর চৌধুরীর কাছে জনপ্রিয়, লড়াকু নেতা হিসেবে তাঁর নাম শুনেছেন তিনি। বিশ্বনাথবাবু প্রচারে তৃণমূলের বাধার প্রসঙ্গ তুললে রাহুল ভয় পেতে বারণ করেন। নিজে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রথমেই রাহুল বিশ্বনাথবাবুর বক্তব্যের প্রশংসা করেন। আপ্লুত বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘অধীরদা আগেই ভরসা জুগিয়েছেন। বামেরা সর্বতোভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আর আজ রাহুল গাঁধী আমার আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন।’’

এ দিন মঞ্চে জোটের সমর্থনে কথা বলেন রাহুল। বাম-কংগ্রেস জোট হওয়ার পিছনে বাম নেতা-কর্মীদের ইতিবাচক মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। কংগ্রেসের দেবেশবাবু, সিপিএম নেতা পঙ্কজবাবুরা জানান, রাহুল জানতে চেয়েছেন, দুর্গাপুরের দু’টি আসনেই জয় আসবে কি না। দু’দলের নেতারা এক সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ বলায় মুখে হাসি ফোটে রাহুলের মুখে। পঙ্কজবাবুরা বলেন, ‘‘যত দিন যাচ্ছে সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে তৃণমূলকে হারাতে মানুষ একজোট হচ্ছেন। এ দিনের সভায় উপচে পড়া ভিড় তারই প্রমাণ।’’

রাহুলের বক্তব্যে এ দিন উঠে এসেছে স্থানীয় সমস্যার কথাও। তিনি বলেন, ‘‘এক সময়ে এই শিল্পাঞ্চলকে জার্মানির শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করা হত। এখন সে সব স্বপ্ন হয়ে গিয়েছে। আমরা জিতলে শিল্প হবে। বেকার যুবকদের চাকরি হবে।’’ কুলটির জলের সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এখানে মনমোহন সিংহের সরকার জলপ্রকল্প করার জন্য টাকা দিয়েছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। সেই টাকা ফেরত চলে গিয়েছে।’’

রাহুল গাঁধীর সভা নিয়ে তৃণমূলের আসানসোল জেলা সভাপতি ভি শিবদাসন অবশ্য বলেন, ‘‘যা খবর পেয়েছি, মোটেই তেমন লোক হয়নি। বাইরে থেকে এসে কে কী বলে গেলেন, মানুষ সে সব বিশ্বাস করবেন না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement