বেলেঘাটার শান্তি সঙ্ঘ স্কুলের কাছে একটি বুথের বাইরে ভোটারদের হুমকি দিতে দেখে সক্রিয় পুলিশ। বৃহস্পতিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
হঠাৎই যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল পুলিশ!
এই সে দিনও হামলার মুখে টেবিলের তলায় ঢুকে মুখে ফাইল চাপা দিয়ে লুকিয়ে পড়েছিল আলিপুর থানার পুলিশ। শাসক দলের নেতারা তো বটেই, আইনভঙ্গকারী দুষ্কৃতীরা পর্যন্ত যে যার মতো পুলিশ পিটিয়ে চলেছিল। পুলিশকে যেন ভয় পেতেই ভুলে যাচ্ছিলেন মানুষ। ১৭ এপ্রিল বীরভূমের ভোট থেকেই ‘আসল চেহারা’-য় ফিরতে চেষ্টা করছিল পুলিশ। বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফার নির্বাচনে সেই চেষ্টাটা আরও ব্যাপক হল। বিরোধীরা কম-বেশি সবাই পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি পুলিশের অতি সক্রিয়তার নালিশ গিয়েছে তৃণমূল ভবনে এ দিন কেমন সক্রিয় ছিল পুলিশ?
বেলা ১০টা। জোড়া ফুলে ছাপ না-দিলে ফল ভাল হবে না বলে বেলেঘাটার শান্তি সঙ্ঘ বিদ্যায়তন স্কুলে ভোটারদের হুমকি দিচ্ছিল কিছু ছেলে। কেউ এক জন ফোন করে খবরটা পৌঁছে দিলেন পুলিশের কানে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বিরাট পুলিশ বাহিনী পৌঁছে লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করতেই পড়িমড়ি ছুট লাগাল ছেলেগুলি। তার মাঝখান থেকেই এক জনের কলার চেপে ধরলেন কলকাতা পুলিশের ডিসি (ইএসডি) ধ্রুবজ্যোতি দে।
বিকেল পাঁচটা। খবর এল মানিকতলা কেন্দ্রে হোলি চাইল্ড স্কুলের কাছে এক সিপিএম কর্মীকে ধরে মারা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে গেল পুলিশের বড় একটা দল। গাড়ি থেকে নেমেই লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল হামলাকারীদের উপরে। পুলিশ যে তাদের এমন ভাবে আক্রমণ করবে, তা যেন ভাবতেই পারেনি হামলাকারীরা।
জেলাতেও একই ছবি। বীরভূম থেকে লোক এনে বর্ধমানের কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, আউশগ্রামে ভোট করানোর ছক ছিল অনুব্রত মণ্ডলের। বর্ধমান জেলা পুলিশ যে তাঁকে নিরাশ করবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন অনুব্রত। কারণ, ভোট করাতে বর্ধমানে হাজির হয়েছিলেন ওই জেলায় এক সময় কাজ করে যাওয়া কিছু পুলিশকর্তা। কিন্তু অনুব্রত মণ্ডলের আশা পূরণ হয়নি। জেলা পুলিশের বর্তমান কর্তারা এতটাই কড়া ছিলেন যে লোক ঢোকানোর ঝুঁকি নিতে চাননি বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা। পুলিশ যে সহযোগিতা করেনি, সেই নালিশ অনুব্রত পৌঁছে দিয়েছেন তৃণমূল ভবনে।
কীসের তাগিদে হঠাৎ এমন বদলে গেল পুলিশ? শাসক দলের দলদাসের ভূমিকা ছেড়ে বিরোধীদের প্রশংসাই বা কুড়িয়ে নিল কী ভাবে?
ভোটের আগে রাজীব কুমারকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে সরিয়ে এবং রাজ্যের ডিজিপি-কে কড়া দাওয়াই দিয়ে নির্বাচন কমিশন যে বার্তা দিতে চেয়েছিল, এটা তারই প্রভাব বলে মনে করছেন লালবাজার ও ভবানী ভবনের কর্তাদের একটা অংশ। লালবাজারের অন্দরের খবর, ভোটের দিন নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রাখতে যা যা করা দরকার, সব কিছুরই অনুমতি দিয়েছিলেন নতুন পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র। ডিজি-র কাছ থেকেও বার্তা গিয়েছিল নিচুতলার অফিসারদের কাছে। বলা হয়েছিল রাজনৈতিক রং না-দেখেই কাজ করতে। এই প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের এক অফিসার জানান, বীরভূমের নির্বাচনের আগের দিন জেলার সব আইসি-দের ডেকে এক আইজি বলে দিয়েছিলেন, বছরের একটি দিন (নির্বাচন) তাঁরা যেন প্রশাসনের জন্য কাজ না করেন। নির্দেশ ভঙ্গকারীদের যে তিনি সাজা দেবেন, সে কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন ওই আইজি। সেই নির্দেশটাই পৌঁছে গিয়েছে কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের নিচু স্তরে।
পুরভোটে উত্তপ্ত থাকা কলকাতার কাশীপুরে সকাল থেকেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন ডিসি (নর্থ) শুভঙ্কর সিংহ সরকার-সহ তিন জন ডেপুটি কমিশনার। সঙ্গে বিরাট কেন্দ্রীয় বাহিনী। দফায় দফায় টহল হয়েছে। অলিগলিতেও আনাগোনা ছিল পুলিশের। এলাকার দুই ‘দাদা’ স্বপন চক্রবর্তী ও আনোয়ার খানকে বোতলবন্দি করে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে এনেছিল বাহিনী। তবে এ সবের মধ্যেই কমিশনকে অকথ্য গালিগালাজ করতে শোনা যায় আনোয়ার খানকে। কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে আঁচ করে পুলিশের নজরদারি গলে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন তৃণমূল নেতা আনোয়ার। কমিশন যখন আনোয়ারকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিল, দেখা গেল পাখি পালিয়েছে। পুলিশের কৃতিত্বে দাগ বলতে এ’টুকুই। চার ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য পাকড়াও করা হয় আনোয়ারকে।
তবে এ সবের মধ্যে কিছু কিছু ‘অতিসক্রিয়তা’র অভিযোগও উঠেছে। যেমন, ভোট এলাকায় দোকানপাট বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু উত্তর কলকাতার একটি নামী মিষ্টির দোকান সে নির্দেশ না-মানায় সেখানে পুলিশ ঢুকে মালিককে মারধর করে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর লাঠির আঘাতে মানিকতলা কেন্দ্রের অরবিন্দ সরণিতে সোনি সাউ নামে এক যুবক আহত হন। পুলিশের দাবি, সোনির কাছে কোনও বৈধ পরিচয়পত্র না-থাকায় জওয়ানেরা তাঁকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন। সোনি পাল্টা জওয়ানদের উপরে চড়াও হলে তাঁকে লাঠিপেটা করা হয়। মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের মেয়ে শ্রেয়া পাণ্ডের অভিযোগ, ‘‘মহিলাদের ওপরেও লাঠি চালিয়েছে পুলিশ।’’
লালবাজার সূত্রের খবর, এ দিন ছ’শোর মতো অভিযোগ জমা পড়েছে। ১০০ নম্বরে ফোন করে ও ই-মেলেও অনেকে অভিযোগ জানিয়েছেন। অভিযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকেও। দিনের শেষে অনেকটা তৃপ্ত যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘অভিযোগ পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শহরে কোনও বড় গোলমাল ঘটেনি।’’ ৬৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু বেলেঘাটা থেকেই ধরা হয়েছে ৫২ জনকে।
তবে পুলিশের এ দিনের ভূমিকায় বিরোধীরা খুশি। চৌরঙ্গির কংগ্রেস প্রার্থী সোমেন মিত্র বলেন, ‘‘আমরা চেয়েছিলাম মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিক। সেই ব্যবস্থা পুলিশ করে দিয়েছে।’’ কংগ্রেস নেতা প্রকাশ উপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘আমি পুলিশ কমিশনারকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছেন।’’ সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মতে, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া পুলিশের ভূমিকা ভাল। মানিকতলা, কাশীপুর-বেলগাছিয়া, বেলেঘাটার কিছু এলাকায় তৃণমূল হামলা চালানোর চেষ্টা করলেও পুলিশের জন্য সফল হয়নি। পুলিশের প্রশংসা করেছেন জোড়াসাঁকোর বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিংহও। তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন পুলিশকে ঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে। রাজীব কুমার অপসারিত হওয়ায় কলকাতা পুলিশ নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পেরেছে।’’
কী বলছে শাসক দল? তৃণমূল ভবন কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে উত্তর কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘পুলিশ শাসক দলের হয়ে কাজ করেনি।’’