গোকুলে বেড়েছে ভূতেরা

হতে পারে জেল, দায় নেই দলের

ওঝাদের চোখে ধুলো দিয়ে ভোট দিয়ে গিয়েছিলেন ওঁরা। হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। পুলিশ মামলা ঠুকেছে। শিয়রে ঝুলছে সাজা। নেতারা গায়েব। তেমনই কয়েকটি অনাথ ভূতের গল্প।বেলা আড়াইটে। গয়েশপুরের গোকুলপুর আদর্শ শিক্ষায়তনের ২ নম্বর বুথ। ভোট দিতে এসেছেন তিন মহিলা। তাঁদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে বুথের মধ্যে যেতে দিলেন এক জওয়ান। বুথে ঢুকে প্রাথমিক কাজকর্মও সেরে ফেলেছিলেন ওঁরা।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল

কল্যাণী শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:০০
Share:

(উপরে) অর্চনা কর, সোমা অধিকারী ও রুমি মল্লিক। (নীচে) উপরের ভূতেদের হাতে আক্রান্তদের ভোটার স্লিপ। (ডানদিকে) আরও তিন ভূত— কুণাল দত্ত, সায়ক মজুমদার, বাপি কর।

বেলা আড়াইটে।

Advertisement

গয়েশপুরের গোকুলপুর আদর্শ শিক্ষায়তনের ২ নম্বর বুথ।

ভোট দিতে এসেছেন তিন মহিলা। তাঁদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে বুথের মধ্যে যেতে দিলেন এক জওয়ান।

Advertisement

বুথে ঢুকে প্রাথমিক কাজকর্মও সেরে ফেলেছিলেন ওঁরা। ঠিক তখনই স্কুলের গেট থেকে ছুটে এলেন এক জওয়ান। তাঁর সহকর্মীকে বললেন, ওই তিন জনই আগে এক বার স্কুলের অন্য বুথে ভোট দিয়ে গিয়েছেন।

বুথ থেকে তিন জনকে বের করে এনে দেখা গেল, নখে চকচক করছে ভোটের কালি। ভোটার কার্ড তাঁদের নিজেদেরই। তা হলে, ফের কার ভোট দিচ্ছিলেন ওঁরা? ভোটার স্লিপ পরীক্ষা করতেই দেখা গেল, ভোটার স্লিপ অন্য তিন মহিলার। চিত্রগ্রাহকেরা ছবি তুলতে যেতেই তাঁরা ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা তিন মহিলার ভোটার কার্ড আর ভোটার স্লিপ নিয়ে নিতেই বাইরে থেকে রে-রে করে তেড়ে এল শ’খানেক যুবক। জওয়ানরাও পালটা তাড়া করে গেলেন। সেই সুযোগে পালালেন তিন মহিলা। কিন্তু তাঁদের ভোটার কার্ড এখনও পুলিশের কাছে রয়ে গিয়েছে। রয়েছে সেই ভোটার স্লিপগুলিও।

ভোটার কার্ডই বলছে, ওই তিন মহিলার নাম— রুমি মল্লিক, অর্চনা কর এবং সোমা অধিকারী। তাঁরা ওই এলাকারই বাসিন্দা, এলাকায় সক্রিয় তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত। যাঁদের ভোটার স্লিপ নিয়ে তাঁরা ভোট দিতে এসেছিলেন, তাঁরা স্থানীয় গোকুলপুর কলোনির বাসিন্দা। নাম ভারতী চক্রবর্তী, কাকলী মণ্ডল এবং সাধনা দে। তাঁদের ভোটার স্লিপ কী ভাবে পৌঁছোল সোমাদের হাতে?

অনেক খুঁজে যদিও কাকলীর বাড়ি পাওয়া গেল, সাংবাদিক শুনে তিনি বা তাঁর পরিবারের লোকেরা কিছুতেই কথা বলবেন না। শেষমেশ তাঁর স্বামী তুলসী মণ্ডল বললেন, ‘‘দেখুন আমরা কোনও দলেরই সমর্থক নই। আমি অসুস্থ থাকায় স্বামী-স্ত্রী-মেয়ে কেউই ভোট দিতে যাইনি।’’ তাই? কাকলীর ভোটার স্লিপ কোথায়? ‘‘বাড়িতেই রয়েছে হয়তো’’— বললেন কিন্তু তা দেখাতে রাজি হলেন না তুলসী।

ওই এলাকাতেই থাকেন সাধনা দে। জানালেন, তিনিও ভোট দেননি। এর বেশি কোনও কথা বলতেই রাজি হননি তিনি। কিন্তু, তাঁর পরিচিতদের দাবি, তাঁকে বলা হয়েছিল যে তাঁর ভোট পড়ে গিয়েছে। তাই তিনি ফিরে আসেন। কাছেই ভারতী চক্রবর্তীর বাড়ি। তিনিও কোনও কথা বলতে নারাজ। তবে তাঁর এক পড়শির দাবি, তৃণমূলের লোকেরা বুথে যেতে নিষেধ করেছিল। তাদের কথা অমান্য করলে এলাকায় বাস করা যাবে না বলে হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।

শুধু তিন মহিলাই নন।

সে দিন ওই স্কুলেরই অন্য একটি বুথে দ্বিতীয় বার ভোট দিতে গিয়ে ধরা পড়েন তিন পুরুষও। নাম— বাপি কর, সায়ন মজুদার, কুণাল দত্ত। বাপিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা ভোট দেওয়ার ঠিক আগে বুথের মধ্যে থেকে ধরে আনেন। বাপি বলেন, ‘‘ভোট উৎসব চলছে। সবাই দু’টো-তিনটে দিচ্ছে। তাই আমিও দ্বিতীয় বার যাই।’’ সায়ন সরল মনে জানান, মা-মাটি-মানুষের পার্টিকে ভালবেসেই তিনি দ্বিতীয় বার ভোট দিতে এসেছিলেন। কুণালের দাবি, তাঁকে ভোট দিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কে পাঠাল, তার কোনও সদুত্তর তিনি দেননি।

বুথগুলিতে জোটপ্রার্থীর এজেন্ট ছিল না। কিন্তু প্রিসাইডিং অফিসার ভূতেদের ভোট দিতে দিচ্ছিলেন কেন? কোনও প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। এসডিপিও (কল্যাণী) কৌস্তভদীপ্ত আচার্য বলেন, ‘‘মোট ন’জন ভুয়ো ভোটার গ্রেফতার হয়েছিল। পরের দিন জামিন পেলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে।’’ দোষী সাব্যস্ত হলে ছ’মাস থেকে তিন বছর কারাদণ্ডও হতে পারে ভূতেদের।

যার জন্য ভূতগিরি, সেই তৃণমূল নেতারা অবশ্য এক ফুঁয়ে দায় ঝেড়ে ফেলছেন। গয়েশপুর শহর তৃণমূলের সভাপতি তথা পুরপ্রধান মরণ দে বলেন, ‘’কারা দু’বার ভোট দিতে গিয়েছিল, সেটা বলা কঠিন। এটুকু বলতে পারি, দলের দির্দেশ ছিল না। অতি উৎসাহী কিছু লোকের জন্য দলের বদনাম হয়।’’

ভূতেদের চোখ ফুটল?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement