ভোটের ১২ ঘণ্টা আগে শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে বৈশালী ডালমিয়া এবং ববি হাকিম। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
ভোটের ষষ্ঠ দিনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগ্য পরীক্ষার তখন আর ১২ ঘণ্টাও বাকি নেই। এমন সময়ে মমতারই বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরের ‘সত্যম্ টাওয়ারস কমিউনিটি হল’-এ শিল্পপতিদের নিয়ে ঘরোয়া বৈঠকে বসলেন কলকাতা বন্দরের তৃণমূল প্রার্থী তথা মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। এতে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ এবং গুরুতর অন্যায় হয়েছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের।
রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ বিবেক গুপ্ত এবং ব্যবসায়ী মহেন্দ্র জালান গত বুধবার বিভিন্ন শিল্পপতি-ব্যবসায়ীকে ই-মেল পাঠিয়ে শুক্রবার ওই হলে সান্ধ্য চায়ের আসরে ববির সঙ্গে ঘরোয়া আলাপচারিতার
আমন্ত্রণ জানান। বিষয়টি নিয়ে এ দিনই কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানায় বিজেপি। দলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার ও শিল্পপতি শিশির বাজোরিয়ার বক্তব্য, নির্বাচনের প্রচার শেষের পরে এ ধরনের জমায়েতে কোনও প্রার্থীর হাজির থাকা নির্বাচনী বিধিভঙ্গ।
তৃণমূল অবশ্য এতে দমেনি। নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে ‘সত্যম টাওয়ারস’-এ গিয়ে দেখা যায়, আয়োজন প্রস্তুত। অতিথিদের জন্য অপেক্ষা করছেন নিমন্ত্রণকর্তা বিবেক এবং মহেন্দ্র। ধীরে ধীরে জনা ৫০ শিল্পপতি-ব্যবসায়ী জড়ো হন। বিজেপি-র অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বিবেক বলেন, ‘‘আমি শিশির বাজোরিয়াকেও নিমন্ত্রণ করেছিলাম। কিন্তু উনি এখানে না এসে সাংবাদিক সম্মেলনে করেছেন। কিন্তু এখানে আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের ব্যানার রাখিনি। এখানে কেবল অবাঙালি ব্যবসায়ীদের ভোট দিতে যাওয়ার আবেদন জানানো হবে।’’ বিবেকের দাবি, বিজেপি-র সাংবাদিক সম্মেলনের পরে তাঁরা নির্বাচন কমিশনকেও ওই অনুষ্ঠানের কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
বিবেকের ব্যাখ্যা, অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গিয়েছে, আলিপুর অঞ্চলের অবাঙালি ব্যবসায়ীদের ভোট দিতে যাওয়ার প্রবণতা কম। তাঁরা ভোটের দিন ছুটি কাটাতে পছন্দ করেন। এই প্রেক্ষিতেই কেবল ভোটটা দিতে যাওয়ার আবেদন জানাতে তাঁদের চায়ের আসরে ডাকা হয়েছে। কিন্তু ওই আসরে উপস্থিত প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার কন্যা, বালির তৃণমূল প্রার্থী বৈশালী ডালমিয়া অবশ্য সব রাখঢাক ঝেড়ে ফেলে সাফ বলে দেন, ‘‘আমি আপনাদের বলব, তৃণমূলকেই ভোট দিন!’’ সামাল দিতে মহেন্দ্র তখন বলেন, ‘‘এটা বৈশালী বলতে পারে। কিন্তু আমরা বলছি, যাকে ইচ্ছা ভোট দিন।’’ এর পর আসরে আসেন ববি। সাংবাদিক এবং চিত্র সাংবাদিকদের দেখে দৃশ্যতই অবাক ববিকে বলতে শোনা যায়, ‘‘এখানে প্রেস?’’ তবে বক্তৃতায় ববি বলেন, ‘‘আমি এই এলাকার ছেলে। আজ এখানে প্রচার করতে আসিনি। আজ সেই কথাটাই বলতে এসেছি, যেটা নির্বাচন কমিশন বলছে। আপনারা ভোটটা দিন। যাকে ভাল লাগে, তাকেই দিন।’’ বৈশালী এর পর ফের বলেন, ‘‘আমরা উন্নয়নের সঙ্গে আছি। উন্নয়নের প্রতীকে ভোট দিন।’’
নির্বাচনী বিধিভঙ্গ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ববি বলেন, ‘‘আমি আর মহেন্দ্র জালান মিলে আলিপুর সিটিজেন্স ফোরাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেছি। এটা তাদেরই উদ্যোগ। এর বেশি কিছু নয়।’’ কিন্তু ভোটের আগের দিন এই বৈঠক কেন? ববির জবাব, ‘‘এত দিন ভোটের প্রচারে ব্যস্ত ছিলাম।’’ ওই আসরে ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের মধ্যে ছিলেন দীপক জালান, রবীন্দ্র বাঘানি, সুশীল পোদ্দার, ঘনশ্যাম সুবাসারিয়া, কমল গাঁধী প্রমুখ। তাঁদের একাংশও ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, ভোটের আগের দিন ডেকে উন্নয়নের জন্য ভোট দিতে বলার অর্থই তৃণমূলের প্রচার করা! ফলে, চায়ের নিমন্ত্রণের আসল উদ্দেশ্য ধরা পড়ে গিয়েছে। তাঁদের কারও কারও বক্তব্য, বিভিন্ন আবাসনের বাসিন্দাদের ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে এসেছে তৃণমূল। অথচ ব্যবসায়ীদের ডেকে ভোট দিতে যেতে বলছে!
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘এটাকে বলে মরণকালে হরিনাম। যে সব ব্যবসায়ী-শিল্পপতি তৃণমূল জমানায় তোলাবাজি, গুন্ডামিতে অতিষ্ঠ, বিধি ভেঙে তাঁদের ভোটের আগের রাতে ডেকে বোঝানো হচ্ছে, ভোটটা দিতে আসুন! তবে এতে শেষ রক্ষা হবে না।’’ বিজেপি-র জয়প্রকাশবাবুর বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ববি হাকিমরা চাইলেই কমিশনের বিধি উঠে যেতে পারে না। কমিশনকে এ ব্যাপারে নজর রাখতে বলেছি।’’