নেপথ্য নায়ক

প্রায় বন্ধ মাঠে নামা, মেজাজ কিন্তু ধরে রেখেছেন কমরেড

দুধ-সাদা পাঞ্জাবি পরা শরীরটা সে দিনও অনবরত দুলছিল। কথাও জড়িয়ে যাচ্ছিল ঘনঘন। স্নায়ুর কঠিন অসুখের কথাটা তদ্দিনে সাত কান না হলেও বোঝা যাচ্ছিল, শরীরটা ভাল

Advertisement

প্রসূন আচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৩
Share:

দুধ-সাদা পাঞ্জাবি পরা শরীরটা সে দিনও অনবরত দুলছিল। কথাও জড়িয়ে যাচ্ছিল ঘনঘন। স্নায়ুর কঠিন অসুখের কথাটা তদ্দিনে সাত কান না হলেও বোঝা যাচ্ছিল, শরীরটা ভাল

Advertisement

নেই। পোড় খাওয়া কমরেডের একরোখা মেজাজটা কিন্তু অটুট! বলেছিলেন, ‘‘একটা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোর হাত মেলাতে অসুবিধা কী?’’ তা বলে কংগ্রেস-বাম জোট হবে? আরও এক পর্দা গলা চড়িয়ে সামনের টেবিল চাপড়ে বলেছিলেন, ‘‘হবে না-ই বা কেন? রাজনীতিতে স-অ-ব হতে পারে। সব। তা ছাড়া আদর্শের সঙ্গে কোথায় আপস হচ্ছে মশাই?’’

সতেরো মাস পরে। বিধাননগরের ছাপোষা বাড়ির এক তলার বসার ঘর। দেওয়ালে জ্যোতি বসুর বড় ছবি। উপরের ঘরে থরেথরে বই। শ্রেণি সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনীর সঙ্গেই চমৎকার সহাবস্থান আধুনিক নগর গড়ে ওঠার বৃত্তান্তের! কাঠের চেয়ারে বসে তিনি। শরীর আরও খারাপ হয়েছে। ইদানিং একা চলতেও অসুবিধা হয়। পরনে হাফ প্যান্ট, টি-শার্ট, মাথায় টুপি। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের পর থেকে টুপিটা পরে থাকতে হয় সব সময়। কমরেডের মেজাজ কিন্তু সেই এক! টিভির পর্দা থেকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ‘‘কী, হল তো? দিদিমণি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন কংগ্রেস-সিপিএম জোট হবে? পলিটব্যুরো, প্রকাশ কারাট— কত অজুহাত! আমরা জিতলাম কি না!’’ স্বাভাবিক ভাবে হাসতেও আজকাল একটু সমস্যা হয়। তবে তৃপ্তির অভিব্যক্তিটা স্পষ্ট। একটু পরেই কঠিন হয়ে গেল চোয়াল। বললেন, ‘‘দিল্লির নেতাদের তো ভোটে জিততে হয় না! বুঝবে কী করে? বাংলার ভোটে ‘ইনডেক্স অব ইউনিটি’রও একটা অঙ্ক আছে!’’

Advertisement

চেনা যাচ্ছে মানুষটাকে? শিলিগুড়ি-মডেল তো অনেক পরের কথা। তৃণমূল-বিরোধী জোটের ভাবনা যে মাথা থেকে প্রথম বেরিয়েছিল, ইনি আলিমুদ্দিনের সেই কমরেড। গৌতম দেব। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এই সদস্য সুস্থ থাকলে ভোট-বাজারের দুপুরে বিধাননগরের এই ঘরে যে তাঁর দেখা মিলত না, বাজি ধরে বলা যায়। এ-ও বলা যায়, অধীর চৌধুরী-আব্দুল মান্নানদের সঙ্গে রাজ্য জুড়ে তাঁর চার ডজন সভা হয়ে যেত। অনর্গল আগুন ধেয়ে যেত তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে গৌতমের কামান দাগা অবশ্য নতুন নয়। শুরুটা ২০১০। স্নায়ুর অসুস্থতা ক্রমশ বাড়ছে। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমা এবং তাদের সঙ্গে তৃণমূলের যোগ নিয়ে প্রথম
সরব হন তিনিই। ২০১১-য় ভোটপর্বের মধ্যেই বলেছিলেন, বাইপাসে দলের দফতরে বসে তৃণমূলের প্রায় সব প্রার্থীকে নগদে বিপুল টাকা বিলিয়েছেন মুকুল রায়, তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। ওই টাকার প্রাপ্তিকে বৈধ দেখাতে অসংখ্য কুপন ছাপানো হলেও সেগুলি বিলিই হয়নি! ভোটবাজারে এমন অভিযোগেও অবশ্য মমতা ঝড় থামানো যায়নি। হাসনাবাদ থেকে সরে এসে দমদমে দাঁড়িয়েও জিততে পারেননি গৌতম। তৃণমূলের প্রার্থী, নাট্যকার ব্রাত্য বসুর কাছে হেরেছিলেন।

তাতেও অবশ্য দমে যাননি এক সময়ের দাপুটে ছাত্রনেতা। তত দিনে স্নায়ুর অসুখটা আরও বেড়েছে। কথা বলতেও কষ্ট। ২০১৩-র এপ্রিলে সারদা-কাণ্ড সামনে আসার দিন কয়েকের মধ্যেই বলেছিলেন, সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ডেলোর বাংলোয় গভীর রাতে বৈঠক করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায়রা। জ্যোতি বসুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই প্রাক্তন মন্ত্রীর এমন অভিযোগ নিয়ে হইচই যত না হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি হয়েছিল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। গৌতম কিন্তু থামেননি। ২০১৪-র এপ্রিলে লোকসভার ভোটপর্বে আবার বোমা! মমতার আঁকা ছবি প্রায় দু’কোটি টাকায় বিক্রির খবরও তিনিই দেন। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁর অসুস্থ শরীরের নানা বিভঙ্গ নিয়েই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বেশি হয়! যদিও পরবর্তী সময়ে তাঁর সব অভিযোগই সারবত্তা পেয়েছে।

এ হেন গৌতম দেব যখন প্রথম কংগ্রেসের হাত ধরার কথা বলেন, তখন দলেরই একটা অংশের সে কী তীব্র বিরোধিতা। কিন্তু তিনি কি থেমে থাকার? বরং যুক্তি দিয়ে একে একে দলের বিরোধী অংশকে বোঝাতে পেরেছিলেন, মমতাকে হারাতে গেলে কংগ্রেসের হাত ধরা ছাড়া গতি নেই।

কেমন আছেন তিনি এখন? কী করছেন?

স্নায়ুর অসুখে এক রকম ঘরবন্দি। সকাল-বিকেল ফিজিওথেরাপি চলছে। এ ঘর থেকে ও ঘর যেতেও মাঝে মধ্যে সাহায্যের দরকার হয়। ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়ার তালিকাটাও লম্বা। এমনকী বাচনভঙ্গি ঠিক রাখার জন্যও ওষুধ খেতে হয়।

মাঝে মাঝে সকালের দিকে ফোন করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শরীরের খোঁজখবর নেওয়ার পর কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার আসন ধরে ধরে একটু কথা হয়। অসুস্থতার জন্য উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়ালেও বকলমে জেলায় দলীয় সংগঠন অনেকটাই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তাই বিমান বসুও ফোন করে উত্তর ২৪ পরগনায় ফ্রন্টের প্রচার নিয়ে কথা বলেন। দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই কমবেশি দু’বেলা ফোন করেন। সবটাই মোবাইলে। মোবাইলটাই এখন তাঁর আলিমুদ্দিন, অফিসঘর! মাঝে মধ্যে বারাসতে জেলা পার্টি অফিসে যান। তবে খুব বেশি নয়। তাই মোবাইলেই কখনও ধরছেন আমডাঙার সিপিএম প্রার্থী আব্দুস সাত্তারকে, কখনও বসিরহাটের নেতা মৃণাল চক্রবর্তী বা কামারহাটির মানস মুখোপাধ্যায়কে।

শুধু নিজের দলের লোকেদের নিয়ে নয়। কংগ্রেসের প্রার্থীদের নিয়েও সমান চিন্তা গৌতম দেবের। কংগ্রেসের অরুণাভ ঘোষকে তিনিই রাজি করিয়ে বিধাননগর কেন্দ্রে দাঁড় করিয়েছেন। সিপিএমের লোকাল কমিটিগুলি কী ভাবে অরুণাভবাবুর হয়ে কাজ করছে, সে খবর রাখতে হচ্ছে তাঁকেই। আবার বসিরহাট দক্ষিণ, বাদুড়িয়ায় কংগ্রেসের কী অবস্থা, সে খবরও রাখছেন। জেলার ৩৩টি আসনের কোনটি ‘ডাউন’, কোথায় ‘আপ’ হচ্ছে, নির্দেশ চালাচালি করছেন দলের মধ্যে।

কিন্তু ফোনে আর কতটা হয়? খুব বেশি যে সম্ভব নয়, স্বীকার করে নিলেন দমদম উত্তর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্য। আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘‘জোটের যে ঝড় উঠেছে, ফুল ফর্মের গৌতমদা থাকলে তা সাইক্লোনে পরিণত হতো! উনি আজ মাঠে থাকলে আরও প্যাঁচে পড়তেন দিদি।’’ একই আক্ষেপ দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী শমীক লাহিড়ীর। বললেন, ‘‘ভোটের জনসভা বা পার্টির বৈঠক— গৌতমদার জুড়ি নেই। গৌতমদার সভা মানেই উপচে পড়া ভিড়।’’

গৌতম নিজেও জানেন সে কথা। তাই পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও গোঁ ধরছেন অন্তত একটা-দু’টো সভায় যাবেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি যাবই।’’ গিয়েওছিলেন। খড়দহে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের অনুরোধে তাঁর হয়ে প্রচারে। কথা যাতে জড়িয়ে না-যায়, সে জন্য ওষুধও নিয়েছিলেন গাড়িতে। সে দিনই রহড়ায় সভায় বলেছেন, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হবে কিনা, তা নিয়ে আমরাও সন্দিহান ছিলাম। আমাদের দলেও অনেকের আপত্তি ছিল। কিন্তু মমতাই আমাদের এক করে দিয়েছেন।’’ তার পরে সুর আরও চড়িয়ে বলেছেন, ‘‘ওরা ভয় পেয়ে গেছে! থই পাচ্ছে না! জোট জিতবেই।’’ পাশে বসা অরুণাভ ঘোষ, আব্দুল মান্নানরা হাততালি দিয়ে উঠেছেন তাঁর কথা শুনে।

কমরেডের জেদ কিন্তু যায়নি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement