মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা নয়। এ বারের নির্বাচনে সংঘর্ষের আশঙ্কা অন্যত্র। জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর নিয়ে এমনই তথ্য উঠে এল গোয়েন্দা রিপোর্টে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার তিনটি বিধানসভা এলাকা ‘অতি সংবেদনশীল’। তার মধ্যে দু’টি বাম-কংগ্রেস জোটের দুই মাথা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং মানস ভুঁইয়ার গড়। নারায়ণগড় ও সবং ছাড়া তৃতীয় যে এলাকায় সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা, সেটি হল কেশপুর।
কেন এই তিনটি এলাকা অতি সংবেদনশীল?
জেলা রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, যেহেতু এ বার তৃণমূলের সঙ্গে লড়াইয়ে বোঝাপড়া হয়েছে বাম-কংগ্রেসের, তাই জোটের নেতাদের ঘাঁটিতে তৃণমূলের সঙ্গে সংঘাতের আশঙ্কা বেশি। আর কেশপুর তো বরাবর অশান্তির এলাকা। জেলার এক পদস্থ পুলিশ আধিকারিকের কথায়, “এই তিনটি জায়গাতেই শাসক দল বিরোধী ভোটারদের বুথে যেতে বেশি বাধা দেবে। ফলে, সংঘর্ষ ঘটবে।”
অশান্তির আশঙ্কা ধরা পড়ছে বিরোধী নেতাদের গলাতেও। কংগ্রেসের জেলা সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়ার অভিযোগ, “সবংয়ে তো তো ধমক শুরু হয়ে গিয়েছে। ভোটের পর পুলিশ চলে গেলে দেখে নেব বলে হুমকি দিচ্ছে।” সিপিএমের জেলা নেতা সত্যেন মাইতিও বলেন, “একটা ঝান্ডা বাঁধলেই তেড়ে আসছে। পার্টি অফিস খুললে জল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এর থেকেই তো বোঝা যায় ভোটের দিন কী হবে।” বিজেপি-র জেলা সভাপতি ধীমান কোলের আবার অভিযোগ, “যাতে আমাদের ভোটাররা ভোট দিতে না যান, সে জন্য সিভিক ভলান্টিয়াক, ভিলেজ পুলিশকে কাজে লাগানো হচ্ছে।” এ সব অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব। দলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি দীনেন রায় বলেন, “কাল্পনিক অভিযোগ। এর জবাব হয় না।”
তৃণমূলের দুই সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নারায়ণগড়ে সূর্যকান্ত মিশ্রকে ৫০ হাজারের বেশি ভোটে হারানোর চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন প্রকাশ্য সভাতেই। কিন্তু তা বাস্তবায়িত করা যে সহজ নয়, তা মানছেন তৃণমূলের একাংশ। ২০১১ সালে পরিবর্তনের ঝড়েও এই কেন্দ্র থেকেই জিতেছিলেন সূর্যবাবু। যদিও জয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ৭২০৯। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য নারায়ণগড়ে ২৯৪০৫ ভোটে এগিয়ে তৃণমূল। দু’বছর পরে এ বার ভোটের পরিস্থিতি যদিও আলাদা। জোট হওয়ায় বিরোধীদের বাড়তি জোর তৈরি হয়েছে। বাম শিবিরও তুলনায় চাঙ্গা। অনেক ঘরছাড়া নেতা-কর্মী ফিরে এসেছেন। সিপিএমও তলায় তলায় সংগঠনকে অনেকটা গুছিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাড়তি ফায়দা হিসেবে রয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল। মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা জেলা নেতা প্রদ্যোৎ ঘোষকে প্রার্থী করায় ক্ষোভ রয়েছে দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেই। সেই ছাই-চাপা আগুন শাসক দলের ভাবনা। এই সব কাঁটা সরিয়ে ভোটে জিততে হলে তৃণমূলকে বলপ্রয়োগ করতে হবে বলেই মনে করছেন জেলা রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। আর তখনই সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা।
সবংয়ের চিত্রটা একটু আলাদা। এখান থেকে বছরের পর বছর জিতছেন কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা মানস ভুঁইয়া। গত বিধানসভা নির্বাচনে তিনি ছিলেন তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী। সিপিএমকে ১৩ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে এই বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের থেকে কম ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। এ বার আবার স্থানীয় নেতা অমূল্য মাইতির পরিবর্তে খড়্গপুরের নির্মল ঘোষকে প্রার্থী করায় বিস্তর ক্ষোভ দলের অন্দরেই। যা বারবার প্রকাশ্যেও এসেছে। এ বার বাম-তৃণমূলের জোট হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জয়ের জন্য মরিয়া তৃণমূল বিরোধী ভোটারদের আটকানোর চেষ্টা করবে বলেই আশঙ্কা। ফলে, সংঘর্ষ অনিবার্য।
আর কেশপুরের ক্ষেত্রে আশঙ্কার কারণ অন্য। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, কেশপুরে জয়ের রেকর্ড বানাতে চাইছে তৃণমূল। যা আগে করত সিপিএম। এখনও মহিষদা বা চরকার মতো এলাকায় সিপিএমের সংগঠন জোরদার রয়েছে। ২০১১ সালেও এই বিধানসভায় সিপিএমই জিতেছিল। ২০১৪ সালের লোকসভায় অবশ্য সিপিআই প্রার্থীর থেকে ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৮৬০টি ভোট বেশি পেয়েছিল তৃণমূল। তাই এ বার রেকর্ড ভোটে জিততে ঝাঁপাচ্ছে তৃণমূল। তা করতে হলে বিরোধী ভোটারদের আটকাতে হবে। তখনই রয়েছে সংঘর্ষের আশঙ্কা।
এই তিনটি কেন্দ্রের বাইরেও ঘাটাল, খড়্গপুর গ্রামীণ, পিংলা, ডেবরাতেও গোলমালের আশঙ্কা রয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। তবে জঙ্গলমহলে তেমন কোনও দুশ্চিন্তা নেই বলেই পুলিশ সূত্রে খবর। পুলিশের যুক্তি, ওই এলাকাগুলিতে দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর শিবির রয়েছে। স্থায়ী শিবির থাকায় বাহিনীর জওয়ানদের রাস্তাঘাটও চেনা। তার উপর ভোটের জন্য আরও বেশি বাহিনী এসেছে। ফলে দুশ্চিন্তা কম। যদিও জেলা নির্বাচন আধিকারিক তথা জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনার আশ্বাস, “সর্বত্রই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে সব ধরনের পদক্ষেপ করা হবে।”