ভোট জাগ্রত দ্বারে, নারদ হুলে ফুটছে চায়ের ভাঁড়

‘কী দিনকাল পড়ল রে বাবা! হাতে টাকা নিয়ে কেউ বলছে, ‘লটস অফ মানি’, কেউ আবার টাকা নিয়ে চাদরে মুড়ে রাখছেন। মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকার জন্য কত কেতা! তা-ও যদি সৎপথে রোজগার হত।

Advertisement

সুজাউদ্দিন ও সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৬ ০২:৪৬
Share:

নারদ এখন ভোটের দেওয়ালেও।

খবরটা আচমকাই টিভি থেকে ছিটকে পড়েছিল চায়ের টেবিলে।

Advertisement

লালমোহনবাবু থাকলে হয়তো বলতেন, ‘হুল নিয়ে হুলুস্থূল!’

তোমাদের এই এক হয়েছে। কথায় কথায় লালমোহনবাবু, সত্যজিৎ রায়। তা-ও আবার সরণি-টরণি নয়। এক্কেবারে ধরণী।

Advertisement

আর নারদও মাইরি বলিহারি জিনিস। কালে কালে আচ্ছা খেল দেখাচ্ছে। তখন ছিল নারায়ণ, নারায়ণ। এখন হয়েছে পোর্টাল।

তা বাপু, হাঁড়িটা যখন ভাঙতে শুরুই করেছিস, ভাল করে ভাঙলেই হল। তা নয়। আজ একটু, কাল একটু...

হেঁ... হেঁ... দাদা, এরেই কয় সাসপেন্স! ধুম ২, স্পাইডারম্যান ৩ দ্যাখস নাই? এ-ও ত্যামনটাই!

সোমবারের সন্ধ্যা।

সামান্য আগে নারদের দ্বিতীয় কিস্তি মোবাইলে চরকি পাক শুরু করেছে। ডোমকলে চায়ের দোকানে আড্ডাটাও সবে জমে উঠেছে।

মওকা বুঝে ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে কানের কাছে মুখ এনে চা বিক্রেতাও বলে ফেললেন, ‘‘দাদাদের তাহলে আর এক রাউন্ড করে চা দিই।’’ ব্যাস, কাপের পর কাপ চা উড়ছে। নারদের হুল থেকে গারদের ওপারে মদনের ভুল, জোট থেকে ভোটের বাজার— চোখা চোখা বিশ্লেষণ, দাবি, পাল্টা দাবির বহরে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল!

উনুনের আঁচ একটু উস্কে মুচকি মুচকি হাসছেন আব্দুল গনি— ‘‘কর্তা, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এ রকম কত দেখছি! সারদা একটু থিতু হয়েছিল। এখন এই নারদ। যাই, বাবুদের চা-টা আগে দিয়ে আসি।’’

আব্দুল গনি একা নন, নবাবের জেলার সিংহভাগ চায়ের দোকানে ঢুঁ মারলেই আলোচনার বড় বিষয়— নারদ। বহরমপুরের এক চায়ের দোকানদার যেমন বলছেন, ‘‘গলা যত চড়ে, চায়ের অর্ডারও আসে ঘন ঘন। কিন্তু আক্ষেপ একটাই— এই নারদের গুঁতোয় সিনেমা-সিরিয়াল সব লাটে। সর্বক্ষণই শুধু খবরের চ্যানেল!’’

ইসলামপুরে একটি চায়ের দোকান যেমন। সন্ধ্যার পরে গুমটি চায়ের দোকানটাই হয়ে যায় আস্ত একটা স্টুডিও। সঞ্চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যান খোদ চা বিক্রেতাই! গলার আওয়াজ, আর বাছাই সব বিশেষণে খবরের চ্যানেলগুলোও যেন হার মেনে যাবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেই দোকানে ভালই ভিড়। টিভির পর্দায় তৃণমূল নেত্রী কিছু একটা বলছেন।

আচমকা টিভি নীরব করে শুরু হল—‘আচ্ছা, নারদ যা দেখাচ্ছে তা সব সত্যি?’ পাশ থেকে অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক ফুঁসে উঠলেন, ‘‘ও, খারাপ লাগছে বুঝি! ইলিয়াস মহম্মদের সময় আপনার তো সব সত্যি মনে হয়েছিল। ওই দেখুন, কী বলছে আপনাদের শঙ্কুদেব! আপ সির্ফ বোলনা শঙ্কু মুঝে ইয়ে চাহিয়ে। মাতব্বরিটা একবার দেখুন!’’

পিছিয়ে নেই পড়শি নদিয়াও।

‘কী দিনকাল পড়ল রে বাবা! হাতে টাকা নিয়ে কেউ বলছে, ‘লটস অফ মানি’, কেউ আবার টাকা নিয়ে চাদরে মুড়ে রাখছেন। মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকার জন্য কত কেতা! তা-ও যদি সৎপথে রোজগার হত। নিচ্ছিস তো বাবা ঘুষ!’ —চায়ের দোকানে ঢুকেই টিপ্পনিটা ছুড়ে দিয়েছেন বছর তিরিশের যুবক। পরনে জিন্‌স আর হলুদ টি-শার্ট।

বেজার মুখে কেটলি থেকে গরম চা ঢালতে ঢালতে প্রৌঢ় দোকানদারও বিড়বিড় করছেন, ‘‘এই শুরু হল! ভরসন্ধ্যায় গণেশকে এখনও ধূপ-ধুনো দিতে পারলাম না। আর বাবুরা নারদ-নারদ করে এখন দেশ উদ্ধার করবে!’’ ‘‘নাহ্, কাকা। তুমি একদম বাধা দেবে না। ও যে বড় বড় কথা বলছে, এখনও কি প্রমাণ হয়েছে যে, ভিডিওটা জাল না আসল? মনে হল, আর কারও সম্পর্কে চাট্টি নিন্দা করে দিলাম, অপমান করলাম। এটা তো হতে পারে না’— এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁফাচ্ছেন দোকানে বসে থাকা আর এক যুবক। তৃণমূলের কট্টর সমর্থক হিসাবে যাঁকে সবাই চেনেন। আক্রমণের লক্ষ্য অবশ্যই সেই হলুদ টি-শার্ট।

চায়ের গেলাসটা ঠক করে কাঠের বেঞ্চের উপরে রেখে হলুদ টি-শার্ট হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘ওরে, এটা প্রযুক্তির যুগ। টিভির পর্দায় কেমন ঝকঝকে ছবি দেখা যাচ্ছে! ক্যামেরা কখনও মিথ্যে বলে না। তার পরেও আবার প্রমাণের কী আছে রে? এখন তো আবার কেউ কেউ ঘুষ, অনুদান সবই এক করে দিচ্ছেন।’’

করিমপুর কিংবা কল্যাণীতে চায়ের দোকানে মাঝে-মাঝে ঝামেলা এমন পর্যায়ে যাচ্ছে যে, দোকানদারকেও বলতে হচ্ছে, ‘‘নারদের জন্য এ বার আমার দোকানটাই না লাটে ওঠে! আপনাদের এই তর্কের চোটে বাইরের খদ্দেররা কিন্তু দোকানে ঢুকতে ভয় পাচ্ছেন!’’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! যুক্তি, পাল্টা যুক্তিতে গরম হয়ে ওঠে আলোচনা। রাত যত বাড়ে, চড়তে থাকে গলার আওয়াজ। বসন্তের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে ভোটের আলোচনায়।

শুধু শহরাঞ্চল নয়। মফস্সল, গাঁয়ে-গঞ্জেও মুখে মুখে ঘুরছে নারদ-কাণ্ড। তাই বলে জোট প্রসঙ্গও কিন্তু এক্কেবারে মিইয়ে যায়নি। কেউ কেউ আবার নারদ-কাণ্ডকে ফুৎকারে উড়িয়ে বলছেন, ‘‘শুনুন দাদা, এই নারদ-টারদে কিস্যু হবে না। নজর রাখতে হবে জোটের দিকে। সারদার মতো এত বড় একটা দুর্নীতির পরেও ভোট-বাক্সে কোনও প্রভাব পড়েনি। নারদে আর কী এমন হবে!’’

তাঁর যুক্তি, ‘‘এ সবের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— জোট। মমতার কাছে মূল আতঙ্ক এখন এটাই। দেখছেন না, নানা সভায় এখন জোট নিয়ে মমতা অনেক কথা বলছেন। কিন্তু সকলেই বুঝতে পারছেন এই জোট-জুজুতে তৃণমূল নেত্রী বেশ চাপে। ফলে কংগ্রেস ও সিপিএমের জোটটা যদি ঠিক মতো দাঁড়িয়ে যায়, তাহলেই খেলাটা জমে যাবে।’’ সান্ধ্য আড্ডা থেকে চায়ের দোকান, তুফানি তর্ক যেন থামছেই না। ভোট জাগ্রত দ্বারে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement