আঙুলে কালি নিলেন মা, ভোট দিল ছেলে

একমনে ভোটারের হাতে কালি লাগাচ্ছেন পোলিং অফিসার। ব্যাস, সেখানেই শেষ। ভোটটি দিয়ে আসছেন অন্যজন। পটাশপুরের খরুই মাদ্রাসার ১১৬ নম্বর বুথের ছবি। ভোট দিতে ঢুকেছিলেন সুরাতন বিবি। অবশ্য ইভিএম পর্যন্ত গিয়ে তাঁকে আর ভোট দিতে হয়নি।

Advertisement

বরুণ দে

পটাশপুর শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৬ ০০:৩৯
Share:

মায়ের হয়ে ভোট। পটাশপুরের খড়াই সিনিয়র মাদ্রাসা বুথে সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।

একমনে ভোটারের হাতে কালি লাগাচ্ছেন পোলিং অফিসার। ব্যাস, সেখানেই শেষ। ভোটটি দিয়ে আসছেন অন্যজন।

Advertisement

পটাশপুরের খরুই মাদ্রাসার ১১৬ নম্বর বুথের ছবি। ভোট দিতে ঢুকেছিলেন সুরাতন বিবি। অবশ্য ইভিএম পর্যন্ত গিয়ে তাঁকে আর ভোট দিতে হয়নি। তাঁর ছেলে শেখ সবিরুদ্দিনই ভোটটি দিয়ে দেন। একই ঘটনা জসিমন বিবির ক্ষেত্রে। জসিমন আবার ইভিএমের কাছে গিয়েছিলেন। ভোটটা দিয়েছেন তাঁর ছেলে কাশীমুদ্দিন মল্লিক। একজনের ভোট অন্যজন দিচ্ছেন। অথচ, প্রিসাইডিং অফিসার সন্দীপ সাহুকে দেখে মনে হল, তিনি কিছু বুঝতেই পাচ্ছেন না। দিব্যি বসে রইলেন টেবিল আঁকড়ে।

নিজের ভোট ছাড়াও মায়ের ভোটটা যে দিয়েছেন, তা স্বীকার করেছেন সবিরুদ্দিন, কাশীমুদ্দিনরাও। সবিরুদ্দিনের কথায়, “মা চোখে ভাল দেখতে পান না তো! ভুল জায়গায় যদি ভোট দিয়ে দেয়। তাই!” কাশীমুদ্দিন আবার সরল গলায় উল্টো প্রশ্ন করে বসলেন, “কেন মায়ের ভোট কি ছেলে দিতে পারে না?” একটু থেমে তাঁর সংযোজন, “দিয়ে তো দিলাম! ভোটটা ঠিক জায়গায় পড়ল কি না বুঝতে পারছি না। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে মনে হয় অন্য বোতামে আঙুল পড়ে গেল!” আক্ষেপ নেই সুরাতন বিবি, জসিমন বিবির। জসিমনরা বলছেন, “আমরা দিতে পারলাম না তো কী হয়েছে? ভোটটা তো দেওয়া হল।”

Advertisement

এ দিকে ছাপ্পা ভোটের ছবি ক্যামেরাবন্দি হয়ে গিয়েছে জেনেও প্রিসাইডিং অফিসারের দাবি, “এক- দু’জন মহিলাকে চোখে ভাল দেখতে পান না। তাই ছেলেকে নিয়ে বুথে এসেছিলেন। ছাপ্পা ভোট হয়নি।” কিন্তু তেমন ক্ষেত্রে যে বিশেষ ফর্ম পূরণ করতে হয় তা কি জানেন না? ছবি কি মিথ্যা কথা বলছে?

এ বার সন্দীপবাবুর জবাব, “আমি কিছু দেখিনি!”

পাশের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর এমন ছবি দেখেছে কিছুদিন আগেই। কেশপুর-গড়বেতার বহু বুথে ভূতেরা নৃত্য করেছে দাপিয়ে। পূর্বেও সেই ভূত-নৃত্যের অভিযোগ উঠল। পটাশপুরের জোট প্রার্থী, সিপিআইয়ের মাখনলাল নায়েকের দাবি, “বেশ কিছু বুথে অবাধে ছাপ্পা দিয়েছে তৃণমূলের লোকজন। মানুষকে ভয় দেখিয়েছে। বাইরে থেকে লোকজন এনে সন্ত্রাস করা হয়েছে।” সিপিআইয়ের এক সূত্রের খবর, বেশ কিছু বুথে এজেন্ট দেওয়া যায়নি। বেলা গড়াতেই বেশ কিছু বুথ থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়।

দুপুরে দক্ষিণখাড়ের বুথের সামনে গিয়ে দেখা যায়, তৃণমূলের জটলা। বুথের সামনে দিব্যি দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী, রয়েছে পুলিশও। তবে নজর নেই জটলার দিকে! অভিযোগ, জোট-সমর্থক বলে পরিচিতদের ভোট দিতে আসতে হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। কিছু তৃণমূল সমর্থককেও মেপে রেখেছেন শাসক দলের নেতারা। ভোটটা যেন জোড়াফুলেই পড়ে— লালচোখের আড়ে সে কথাই বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। এ বারে ভোটের নিয়ম মেনে ছোলা-মুড়ি বিলিও করেছেন তৃণমূলের লোকেরা।

ভঞ্জেরপুকুরে গিয়ে দেখা গেল, ভোট দিয়ে বেরোনোর পরে ভোটারদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছোলা-মুড়ি। মিনুরানি শীট, বন্দনারানি শীটরা একগাল হেসে বললেন, “ওরা দিল। তাই নিয়ে নিলাম!” ওরা কারা? সব তৃণমূলের লোক? মিনুরানির মন্তব্য, “অন্য কিছু ভাবছেন না কী!”

অভিযোগ উড়িয়ে জ্যোতির্ময়বাবু বলেন, “বিশ্বাস করুন, এ সব কিছু হয়নি। সকাল থেকে এই সব অভিযোগ শুনে শুনে আমি নিজেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি।” তাঁর দাবি, বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী আছে। বাইরে পুলিশ আছে। ছাপ্পা হবে কী করে? জেলার সব আসনেই ভোট চলছে। বাইরে থেকে লোকজন আসবে কী করে? মানুষ নিজের ভোট নিজে দিচ্ছেন।

পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনী সক্রিয় বলে জানিয়ছেন বিদায়ী মন্ত্রী। কিন্তু ভোটারদের ছোলা- মুড়ি খাওয়ানো? হেসেছেন তৃণমূলপ্রার্থী। তাঁর কথায়, “আমার এখানে মুড়ি নেই! জল নেই! গুড় নেই! ছোলাও নেই! শুধু রোদ ছিল!” খরুই মাদ্রাসার সেই বুথের কিছু দূরেই রাখা ছিল নির্বাচন কমিশনের প্রচার- ফেস্টুন। একটায় লেখা, ‘আমাদের ভোট। আমাদের অধিকার। আমাদের গর্ব।’ আরেকটায় লেখা, ‘নোটে নয়, ভোটে থাকুন।’ এক বৃদ্ধাকে কিন্তু দেখা গিয়েছে সেই ফেস্টুনের দিকে তাকিয়ে বলছেন, “আমাদের ভোট আর দিলাম কোথায়?”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement