ঘরের কোণে বন্দি না থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিন — বাড়ির মহিলাদের এ ভাবেই উৎসাহ দিচ্ছে মারোয়াড়ি সমাজ। ভিক্টোরিয়ায় প্রাতর্ভ্রমণে, রাস্তাঘাটে, কারও বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়ে ফিসফিস করে প্রচার। বোঝানোর চেষ্টা চলছে মারোয়াড়ি সমাজের সেই সব পুরুষদেরও, ভোটের দিন লাইনে দাঁড়িয়ে বাড়ির মহিলাদের ভোট দেওয়া নিয়ে যাঁদের অনীহা রয়েছে।
মারোয়াড়ি সমাজের সংগঠন ‘রাজস্থান বেঙ্গল মৈত্রী পরিষদ’-এর উদ্যোগে ভোট দিতে মহিলাদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সংগঠনের নেতা নারায়ণ জৈন এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের সমাজের মহিলাদের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট দেন না। অথচ সবাই মিলে ভোট দিতে শুরু করলে, অনেক কেন্দ্রে আমরা ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারি। তখন আমাদেরও প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে রাজনৈতিক দলগুলো।’’
শনিবার কলকাতার চারটি কেন্দ্রে ভোট। তার মধ্যে ভবানীপুর কেন্দ্রেই মারোয়াড়ি ও গুজরাতি ভোটারের সংখ্যা অন্তত ৬৫ হাজার। মোট ভোটারের প্রায় ২৫%। এ ছাড়া পঞ্জাবি ভোটারও আছেন। নারায়ণবাবুর কথামতো, ভবানীপুরে মারোয়াড়ি মহিলারা যদি শনিবার ভোট দেন, তা হলে এই কেন্দ্রের ফল নির্ধারণে তাঁরা বড় ভূমিকা নিতে পারেন। সমস্যা একটাই, ভোটার তালিকায় নাম নেই অনেক মহিলার।
এই সমাজের অনেকের মতে, সাধারণত ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট এক দিকেই পড়ে। নিজেদের মধ্যে ব্যবসায়িক যোগাযোগের জন্য তাঁরা অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। স্বার্থে আঘাত লাগলে একজোট হওয়ার নজিরও বিস্তর রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক ব্যবসায়ীর মতে, গত কয়েক বছরে পর পর বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি সেই স্বার্থে আঘাত লাগার ঘটনা ঘটেছে।
আলোচনায় উঠে এসেছে গত পুর নির্বাচনের কথা। ভবানীপুরে বসে সেই ব্যবসায়ী বলেছেন, ‘‘সল্টলেকে গত অক্টোবরে আমাদের সমাজের কত জন ভোট দিতে পারেননি সে খবর রাখেন? ঘটনার দিন বিকেলে ভবানীপুরে বসে কত ফোন পেয়েছিলাম জানেন!’’ সে বছর এপ্রিলে কলকাতা পুর নির্বাচনে কিড স্ট্রিটে গুলি চলার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন ওই ব্যবসায়ী।
অভিযোগ, ওই দুই ভোটে অনেক জায়গায় ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে আত্মীয়-বন্ধুদের অনেকে জানতে পারেন, তাঁদের ভোট পড়ে গিয়েছে। তুলনায় যুবক এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘আসলে আমরা বেশি চিৎকার করতে পারি না আপনাদের মতো। সকলে জানে, আমাদের ব্যবসা করে খেতে হবে। বেশি প্রতিবাদ করলে ক্ষতি করে দেবে।’’ এই সূত্রেই উঠল সিন্ডিকেটের প্রসঙ্গ। মারোয়াড়ি সমাজের অভিযোগ— রাজারহাট, নিউটাউন, লেকটাউন, বাগুইআটি-সহ শহর ও শহরতলির বিস্তীর্ণ যে অঞ্চলে সিন্ডিকেটের দাপাদাপি, তার জন্য লোকসানের মুখে ব্যবসায়ীরা। খারাপ গুণমানের মাল কিনতে হচ্ছে বেশি টাকা দিয়ে। এক ব্যবসায়ীর প্রশ্ন, ‘‘বলা হচ্ছে, আমরা ফ্ল্যাট বিক্রির সময়ে সেই টাকা নাকি তুলে নিচ্ছি! যে ফ্ল্যাটের দাম ১ কোটি, তার জন্য আপনার কাছ থেকে আড়াই কোটি চাইলে আপনি দেবেন?’’
সম্প্রতি সব চেয়ে বড় ধাক্কাটি লেগেছে বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে
পড়ার পরে। ঘটনার পর থেকে যাঁদের ব্যবসা চৌপাট হয়েছে, দিনের পর দিন যাঁদের বাড়ি ছেড়ে থাকতে হচ্ছে, তাঁদের ৯০%-ই মারোয়াড়ি সমাজের মানুষ। সেই রাগ-ক্ষোভ শুধু বড়বাজার এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়েছে অন্যত্রও। ভবানীপুরের অফিসে বসে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘শুনছেন তো! সেই উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পিছনেও নাকি সিন্ডিকেট! আপনি জমি কিনে ব্যবসা করতে পারবেন না। সরকার জমি অধিগ্রহণ করে আপনাকে দেবে না। আপনি ছোটখাটো ব্যবসা করতে চাইলে চাঁদার জুলুম। সরকারি ৯০% কাজে ঘুষ। তার উপরে সিন্ডিকেটের কারণে এই প্রাণহানি।’’ তার মানে কি ভবানীপুর-সহ যেখানে যেখানে ভোট হচ্ছে, সেখানে এই সমাজের ভোট শাসক দলের বিরুদ্ধে যাবে?
সরাসরি এই তত্ত্ব না মানলেও ব্যবসায়ীদের একাংশ বলছেন, ‘‘কিছু মানুষ হয়তো শাসক দলকেই ভোট দেবেন। আমাদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থকও রয়েছেন। কিন্তু, মোটের উপরে এই সরকারের উপরে আমাদের সমাজ খুশি নয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট শাসক দলের বিরুদ্ধে যাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি।’’
বিজেপি-কে সমর্থন করার একটা সহজাত প্রবণতার কথা মেনে নিয়েই ব্যবসায়ীদের একাংশ জানাচ্ছেন, জোট-প্রার্থীদের ভাগেও এ বার সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের একাংশ জুটবে বলে মনে করা হচ্ছে।