অমিয়র তালুকে ঢুকেই চড়া সুর

তিন দিন ধরে পাশের পুরুলিয়া জেলার আটটি জনসভায় যে মেজাজে দেখা গিয়েছে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, বুধবার বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের অন্যতম বিধানসভা কেন্দ্র তালড্যাংরার সভায় এসে তা যেন বেমালুম বদলে গেল।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবব্রত দাস

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৬ ০২:৫২
Share:

আক্রমণাত্মক। বুধবার তালড্যাংরায় অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।

গত তিন দিনের চেয়ে আলাদা। আক্রমণের ভাষা আলাদা। মেজাজও আলাদা।

Advertisement

তিন দিন ধরে পাশের পুরুলিয়া জেলার আটটি জনসভায় যে মেজাজে দেখা গিয়েছে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, বুধবার বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের অন্যতম বিধানসভা কেন্দ্র তালড্যাংরার সভায় এসে তা যেন বেমালুম বদলে গেল। এ দিন উপস্থিত জনতা দেখল পুরোপুরি ‘রণংদেহী’ মমতাকে। যিনি বক্তব্যের পরতে পরতে বিরোধীদের উদ্দেশে হুমকি দিয়েছেন। তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন বাম-কংগ্রেস জোটের প্রতি। ‘কড়ায় গণ্ডায় ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে’ বুঝে নেবেন যেমন বলছেন, তেমনই আবার সন্ত্রাসের বদলে কোনও ‘ভদ্রতা’ দেখাবেন না বলেও শুনিয়েছেন।

সব মিলিয়ে স্পষ্ট, জেলার জঙ্গলমহল সিপিএমের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে তৃণমূল এ বার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপাচ্ছে। ২০১১ সালে পরিবর্তনের হাওয়ায় বাঁকুড়ার বাকি ৯টি আসনে তৃণমূল বামেদের দুরমুশ করে জিতলেও জঙ্গলমহলের রাইপুর, রানিবাঁধ ও তালড্যাংরা— এই তিন আসন ধরে রেখেছিল সিপিএম। তাই এ বার তৃণমূল জঙ্গলমহলকে পাখির চোখ করেছে। সে কারণেই বাঁকুড়ায় নিজের প্রথম জনসভাটি তৃণমূল নেত্রী রেখেছেন তালড্যাংরায়। এই কেন্দ্রে এ বার সিপিএমের প্রার্থী হয়েছেন খোদ দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র। বাম আমলে অমিয়বাবুর প্রতাপ এই জেলায় কোন পর্যায়ে ছিল, তা এখনও মানুষের মনে রয়েছে। ওই সময় জেলায় বিরোধী শক্তির মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারার জন্য তালড্যাংরারই বাসিন্দা সিপিএমের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক অমিয়বাবুকে দুষতেন বিরোধীরা।

Advertisement

কাজেই নিজের খাসতালুকে এ বার প্রার্থী হওয়া অমিয়বাবুকে জয়ের পথে বড় কাঁটা হিসেবেই দেখছে তৃণমূল। এ দিকে এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসন সমীক্ষার রিপোর্টেও ভোট-যুদ্ধ অমিয়বাবুর পক্ষে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কলকাতা থেকে মমতার মনোনীত প্রার্থী সমীর (বুয়া) চক্রবর্তীকে জেতানোই একমাত্র টার্গেট তৃণমূলের। কাজেই দলনেত্রী অমিয়বাবুর গড়ে এসে তাঁর বিরুদ্ধে তোপ দাগবেন বলেই অনুমান করেছিল বাম শিবির। হলও তাই। বক্তৃতার শুরুতেই অমিয়বাবুর নাম না করে মমতা বলেন, “তালড্যাংরা সিপিএমের সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর ছিল। চমকাইতলা, গড়বেতা মনে পড়ে? গড়বেতায় রাস্তা খুঁড়ে, আর সারেঙ্গা হয়ে গুন্ডাদের আমদানি হত গোপন পথে। আর যিনি আমদানি করতেন তিনি এখন তালড্যাংরা থেকে দাঁড়িয়েছেন আবার সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর তৈরি করবে বলে। আবার রক্তাক্ত বাংলা তৈরি করবে বলে। আবার বন্দুক ধরে ধরে গ্রামে ঢুকতে শুরু করেছে।’’

এখানেই থেমে থাকেননি মমতা। বিরোধীদের কার্যত হুমকির সুরে বলেছেন, “নির্বাচন তো এক মাস বাদে ফুরিয়ে যাবে। আর আমরাই থাকব মাঠে। আমরাই থাকব ময়দানে। আমরাই থাকব রাস্তায়। কত ধানে কত চাল কড়ায় গণ্ডায় ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব!’’ অনেকেরই মতে এই কথার মাধ্যমে বিরোধী দলের পাশাপাশি প্রশাসনের একাংশও যাঁরা নির্বাচনে নিরপেক্ষ কাজ করছেন তাঁদেরও শাসানি দিয়েছেন মমতা। এ দিন মমতা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, গত চার বছর তিনি উন্নয়নের কাজ করলেও সামনের দু’মাস স্রেফ রাজনীতির কথাই বলবেন।

বস্তুত, বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস যখন জোটের লক্ষে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছি। প্রথমে সেই জোট জোটকে ‘ঘোঁট’ বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তবে ক্রমশ জোটশক্তি যতই নজর কাড়ছে ততই অস্বস্তি বাড়ছে তৃণমূল শিবিরে। এ দিন মমতার আক্রমনাত্মক শরীরি ভাষায় বহু রাজনীতিকই সেই অস্বস্তির ছাপ খুঁজে পাচ্ছেন বিরোধীরা। অমিয়বাবু বলেন, “ওঁর বক্তব্যের প্রতিটি লাইনে ভোটে পরাজয়ের আতঙ্ক ধরা পড়েছে। জোটের শক্তি যতই প্রকাশ্যে আসছে, ততই আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন তৃণমূল নেত্রী। আসলে তৃণমূল কর্মীদের মনোবল হারিয়ে গিয়েছে। তাই তাদের উজ্জীবিত করতেই নানা উস্কানিমূলক কথা বলেছেন মমতা।’’ বাম আমলে সন্ত্রাস চালানোর যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, সে প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “আমার বিরুদ্ধে অনেক অসত্য কথা বলেছেন উনি। বাম আমল ছেড়েই দিলাম। যদি সত্যিই অনৈতিক কাজ করে থাকি, তা হলে পরিবর্তনের পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও কেন মমতার পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করেনি? আজ পর্যন্ত পুলিশের খাতায় আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। তা-ও আমার বিরুদ্ধে এ সব বলা হল!’’

এ দিন তালড্যাংরায় সভা সেরে জঙ্গলমহলেরই আর এক বিধানসভা কেন্দ্র রাইপুরের ফুলকুসমায় জনসভা করেন মমতা। দু’টি সভাতেই ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুলকুসমাতেও তালড্যাংরার আক্রমণের ধারা বজায় রেখে তিনি বলেন, “জঙ্গলমহলে আগে হার্মাদদের নিয়ে অনেক মানুষ খুন করাত সিপিএম। তার পরে মাওবাদীদের নামে চালাত।’’ বিদায়ী সিপিএম বিধায়ক উপেন কিস্কুর নাম না করে তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘এখানের এমএলএ-র সন্ত্রাস করা ছাড়া কোনও কাজ নেই।’’ এর পরেই জনতার উদ্দেশে তাঁর আবেদন, ‘‘জঙ্গলমহলকে আর সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হতে দেবেন না। এখান থেকে এ বার সিপিএমের সাইনবোর্ডই উঠে যাবে!’’

ফুলকুসমায় সভা সেরে সড়ক পথে মমতা খড়্গপুরে যান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement