শ্রীরামপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — প্রকাশ পাল
গঙ্গাপাড়ের একটি বিধানসভা কেন্দ্রে তিনটি চটকল। তার মধ্যে দু’টিই বন্ধ। কয়েক হাজার শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবার বেকায়দায়। প্রতিদিন এ নিয়ে বিরোধীরা আঙুল তুলছিলেন রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার খোদ কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীও শ্রীরামপুরের মঞ্চ থেকে এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই আঙুল তুলেছেন। আর তার পরের দিনই একই জায়গায় দলীয় প্রার্থীর প্রচার মঞ্চ থেকে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধ চটকলের মালিককে হুঁশিয়ারি দিলেন, মিল খুলতে হবে। না হলে কোনও ‘হেল্প’ মিলবে না।
ঘটনাচক্রে তাঁর প্রস্থানের ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই একটি চটকল খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হল। আগামীকাল, শুক্রবার থেকে শ্রীরামপুরের ইন্ডিয়া চটকল খুলবে বলে শোনা যাচ্ছে। যে ঘোষণা শুনে বিরোধীরা বলছেন, ভোটে হাওয়া ভাল নয় বুঝেই তৃণমূলনেত্রী মিল খুলতে চাপ দিয়েছেন। এই তৎপরতা আগে দেখা যায়নি। ভোট মিটলে কী হবে তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থাকছেই।
কাঁচামালের অভাব এবং শ্রমিক বিক্ষোভের কারণ দেখিয়ে এক মাস আগে ইন্ডিয়া চটকলের গেটে বিজ্ঞপ্তি ঝোলান কর্তৃপক্ষ। শ্রমিক অসন্তোষ এবং কাঁচা পাটের সমস্যার কথা বলেই ওয়েলিংটন চটকলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ নিয়ে তৃণমূল এবং কংগ্রেস ও সিপিএমের মধ্যে চাপানউতোর হয়। বিরোধীরা একসুরে অভিযোগ তোলেন, চটকলের পরিস্থিতি বেহাল হওয়ার জন্য তৃণমূলই দায়ী। সে জন্য শ্রমিকেরা তাদের পাশ থেকে সরে গিয়েছেন। চটকলের বহু শ্রমিক ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দা। সেই কারণেই ‘পরিকল্পিত ভাবে’ মিল বন্ধ করা হয়েছে, যাতে শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরে যান এবং শ্রমিকদের ভোট যাতে তাদের বিরুদ্ধে না পড়ে। তৃণমূল অবশ্য পাল্টা সেই দায় চাপায় বিরোধীদের ঘাড়ে। তাদের বক্তব্য, কাঁচা পাটের জোগান দেওয়া মালিকপক্ষের দায়িত্ব। আর পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা না থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার দায়ী।
দলের নেতারা যাই বলুন, বন্ধ চটকল নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছিল শাসক দলকে। এ দিন শ্রীরামপুর স্টেডিয়ামে দলনেত্রী মমতা পৌঁছনোর আগে তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ্ত রায় অভিযোগ করেন, ‘‘এখানে কয়েকটি চটকল আছে। ভোট এলেই সিপিএম এবং কংগ্রেস মিলে মিলগুলো বন্ধ করে দেয়। হেস্টিংস চটকলে আমাদের ২২ জন সমর্থককে ইচ্ছে করে বসিয়ে রাখা হয়েছে।’’ বক্তব্য রাখার সময় মমতার মুখেও উঠে আসে চটকল প্রসঙ্গ। কয়েক মাস বন্ধ থাকার পরে মঙ্গলবারই ভদ্রেশ্বরে বন্ধ নর্থব্রুক চটকল খুলেছে। মমতা বলেন, ‘‘নর্থব্রুক খুলে গিয়েছে। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বাকিগুলোও খুলুন। তা হলে সাহায্য করব। না হলে কিন্তু কোনও সাহায্য করব না।’’
এ দিনই ইন্ডিয়া চটকল নিয়ে কলকাতায় শ্রম দফতরে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক শুরু হয় দুপুর ১টা নাগাদ। চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। আর মমতা শ্রীরামপুরের সভায় আসেন দুপুর পৌনে তিনটেয়। সভা ছাড়েন সাড়ে ৩টে নাগাদ। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, তা হলে কি মালিকপক্ষকে উদ্দেশ্য করে মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি বৈঠকের অন্দরে পৌঁছে গিয়েছিল? শ্রম দফতরের এক অফিসারের অবশ্য বক্তব্য, পূর্ব নির্ধারিত সূচি মেনেই ওই বৈঠক হয়েছে। আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ও চটকল সূত্রের খবর, আপাতত মিল খুলে শ্রমিক এবং মিলের সমস্যা নিয়ে আলোচনা চালানো হবে। গোলমাল পাকানোর অভিযোগে যে ১০ জন শ্রমিককে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের ব্যাপারেও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে ভোটের আগে উৎপাদন চালু হচ্ছে না। শুক্রবার থেকে মিলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হবে। সাত দিন সেই কাজ চলবে। তার পর থেকে ধাপে ধাপে উৎপাদন চালু হবে। এ দিন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের অতিরিক্ত শ্রম কমিশনার মহম্মদ নাসিম, শ্রীরামপুরের উপ-শ্রমকমিশনার অমল মজুমদার। মিলের তরফে ছিলেন মিলের ইউনিট ইনচার্জ অমলেশ মিশ্র, চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার (পার্সোনাল ও প্রশাসন) কল্যাণ মিত্র এবং জেনারেল ম্যানেজার (পার্সোনাল) দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। ৯টি শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, সনিয়া গাঁধীর পাল্টা হিসেবেই এ দিন শ্রীরামপুর স্টেডিয়ামে মমতা সভা করেন। একই মঞ্চে সভা হয়। শ্রীরামপুরের দলীয় প্রার্থী সুদীপ্ত রায় ছাড়াও উত্তরপাড়ার প্রার্থী প্রবীর ঘোষাল এবং চাঁপদানির প্রার্থী মুজফফর খান উপস্থিত ছিলেন। সনিয়া বা রাহুল গাঁধীর নাম না করে মমতা বলেন, ‘‘জোট হয়েছে না লবডঙ্কা হয়েছে। কাজ নেই কর্ম নেই, নির্বাচনের সময় এলে বসন্তের কোকিলের মতো উড়ে চলে আসেন। আর মিথ্যা বলে চলে যাচ্ছেন।’’ তিনি নিজে মিথ্যা বলেন না, বোঝাতে মন্তব্য করেন, ১০০% নিশ্চিত হয়ে তবেই কোনও কথা বলেন। এ সবের পাশাপাশি ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটই যে তাঁর পাখির চোখ তা জানিয়ে দেন তৃণমূলনেত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘দিল্লি আমাদের টার্গেট।’’