মাটির এক চিলতে ঘরের এক কোণে বসে মাটির উনুনে রান্না চড়িয়েছিলেন মহিলা। সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে দেদার দ্বিধা। অনেক বোঝানোর পরে জানালেন, তাঁর স্বামী ভোট দিতে পারেন না। সে জন্যই হাইকোর্টে মামলা করেছেন। তারপর থেকে শাসক দলের হুমকি আরও বেড়েছে, জানালেন মহিলা।
মহিলা বলেন, ‘‘আগে আমরা আরএসপি করতাম। এখন বিজেপি করি। কিaন্তু এই এলাকায় ওদের (তৃণমূল) অত্যাচারে আগে আগে ভোট দিতে পারেননি। ভোট দিতে গেলে মারধর করত। শুধু তাই নয় আমরা বিরোধী রাজনীতি করি বলে ওরা আমাদের জমিতে চাষ ঠিকমতো করতে দেয় না। এই গরমে ফসলে জল দিতে গেলে ওরা বাধা দেয়। আমরা পঞ্চায়েত থেকেও কোনও সরকারি সুযোগ পাইনি।’’ মহিলার আক্ষেপ, ‘‘এ ভাবে কত দিন বেঁচে থাকা যায়!’’ আদালত, নির্বাচন কমিশন নড়ে বসায় এ বার ভোটে দিতে পারবেন বলে আশা তাঁর।
এমন অভিযোগ অবশ্য শুধু ওই পরিবারের নয়। গোসাবা বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত চুনাখালি পঞ্চায়েত এলাকার উত্তর চুনাখালি, বড়িয়া, বয়ারসিং, হরিণখালি, বরপাড়া, খান সর্দারপাড়া, বগুলাখালি, আদিবাসীপাড়া, জানাপাড়া বনদেবীপুর-সহ ওই অঞ্চলের ২৩টি বুথের মধ্যে প্রায় অধিকাংশ বুথে বিরোধীদের এজেন্ট বসতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ। এমনকী, বুথ দখল করে একচেটিয়া ছাপ্পা দেওয়া হয় বলেও দাবি বাম দলগুলির।
২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে ওই অঞ্চলের ২৭টি বুথে বৈধ ভোট পড়ে ১২,৯৯৯টি ভোট। তারমধ্যে বামফ্রন্ট পায় ২,৭৬০টি ভোট, তৃণমূল পায় ৯,৬৮৯টি ভোট, বিজেপি পায় ২৩১টি ভোট। অন্যান্যরা পায় ৩১৯টি ভোট। ২০১৪ লোকসভা ভোটে এই অঞ্চলে বৈধ ভোট পড়ে ১৪,৬৭৯টি। এর মধ্যে বামফ্রন্ট পায় ১,৯৭০টি ভোট, তৃণমূল পায় ১১,১০৬টি ভোট, কংগ্রেস পায় ১৫০টি ভোট, বিজেপি পায় ৮৫১টি ভোট। অন্যান্য পেয়েছিল ৪৩৮টি ভোট। বিরোধী দলের থেকে শাসক দল তৃণমূল এই অঞ্চলের প্রতিটি বুথ থেকে ভোটের মার্জিন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একতরফা ভাবে ভোট পেয়েছে তৃণমূলই। লোকসভার নিরিখে যেমন চুনাখালির ১ নম্বর বুথে ভোট পড়েছে ৭৯২টি। এরমধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ১৫টি ভোট, বিজেপি পেয়েছে ৫৮টি ভোট, তৃণমূল পেয়েছে ৬০২টি ভোট, আরএসপি পেয়েছে ৭৩টি ভোট, এসইউসিআই পেয়েছে ৪টি ভোট। ৩ নম্বর বুথে ভোট পড়েছে ৭৮০টি। যার মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ৬টি, বিজেপি ৪৩টি, এসইউসিআই পেয়েছে ৩টি। সেখানে তৃণমূল একাই পেয়েছে পেয়েছে ৬৩৯টি ভোট।
১৯৭৮ সালে রাজ্যে যখন বামফ্রন্ট সদ্য ক্ষমতায় এসেছে, তখন থেকেই বাসন্তী ব্লকের চুনাখালি পঞ্চায়েতটি কার্যত জয়ন্ত নস্করের দখলে। ১৯৯৮ সালে জয়ন্ত নস্কর কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দেন। চুনাখালি পঞ্চায়েতে কখনও জয়ন্ত নস্কর কখনও তাঁর স্ত্রী অনিতাদেবী প্রধান থেকেছেন। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ন্তবাবু গোসাবা থেকে ভোটে জিতে বিধায়ক হন।
তারপর থেকে তিনি ওই এলাকা বিরোধীশূন্য করে দেন বলে অভিযোগ। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোট, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট ও ২০১৪ লোকসভা ভোটে এই এলাকায় কোনও বিরোধী এজেন্ট বসতে পারেনি বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, পঞ্চায়েত ভোটে এই এলাকায় কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রার্থী দিতে পারেনি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় তৃণমূল। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদল হওয়ার পর থেকে এই এলাকায় জয়ন্তবাবুর দাপট আরও বেড়েছে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
বড়িয়ার এক গ্রামবাসী বললেন, ‘‘এই এলাকার মানুষ কোনও দিন ঠিকমতো ভোট দিতে পারেননি। ওদের কাউকে সন্দেহ হলে তাকে ভোট দিতে দেয় না। নিজেরাই ভোট দিয়ে দেয়। প্রতিবাদ করার কোনও জায়গাই নেই। যদি কেউ প্রতিবাদ করে, তা হলে নানা রকম অত্যাচারের শিকার হতে হয়। উত্তর চুনাখালির এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘জয়ন্তবাবুই এই এলাকার শেষ কথা।’’
স্বভাবতই সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন জয়ন্তবাবু। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা ঠিক বলছেন না। এলাকায় কখনও কাউকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয়নি।’’
তাঁর আরও দাবি, যে ব্যক্তি আদালতে মামলা করেছেন, তাঁর সঙ্গে পাড়ার লোকের বনিবনা হয় না। কথায় কথায় তিনি গ্রামের মানুষের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ান। মামলা করার হুমকি দেন।’’ বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারের প্রার্থীর কথায়, ‘‘এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আমার সঙ্গে আছেন। বিরোধীদের পাশে কোনও লোক না থাকায় তারা এই সব অপবাদ দিচ্ছে।’’