সিঙ্গুরের কাঁটা এখনও বিঁধে আছে। তবু সেই অস্বস্তির মধ্যেই সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বুঝিয়ে দিলেন, সিঙ্গুরে জমি নেওয়ার পদ্ধতিতে ভুল হলেও বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পায়নই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য।
আলিমুদ্দিনে আনন্দবাজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘জ্যোতি বসুর সময়েও উন্নয়ন ও শিল্পায়নের জন্য অনেক জায়গায় জমি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোথাও সিঙ্গুরের মতো ঘটনা ঘটেনি। আসলে সিঙ্গুরের মানুষের সঙ্গে আগে আলোচনা না করে জমি নেওয়ার পদ্ধতিতে ভুল হয়েছিল। কিন্তু শিল্পায়ন ছাড়া রাজ্যের উন্নয়নের পথ নেই।’’ জোট সরকার ক্ষমতায় এলে কর্মসংস্থানের জন্য বড়, মাঝারি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার উপরে জোর দেওয়া হবে বলে ইয়েচুরি জানান। তাঁর কথায়, ‘‘শিল্পায়ন ছাড়া বিকল্প নেই।’’
ভোটের শেষ লগ্নে সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি সিঙ্গুর-বিতর্কে নতুন মাত্রা এনেছে। জোট সরকার ক্ষমতায় এলে মামলা তুলে নিয়ে সিঙ্গুরে শিল্পের পথে এগোনো হবে বলে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন। ইয়েচুরি নিজেও সিঙ্গুরে দলের প্রার্থী রবীন দেবের হয়ে প্রচারে গিয়েছিলেন। যদিও ‘কেরল-অস্বস্তি’ এড়াতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সঙ্গে একসঙ্গে মঞ্চে ছিলেন না। কিন্তু সিঙ্গুর যে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের কফিনে পেরেক পুঁতে দিয়েছিল, সিপিএমের কর্মীরা আজও তা ভুলতে পারেননি।
কেন এমন হল? ইয়েচুরি বলেন, ‘‘২০০৬ সালে আমরা শিল্পায়নের স্লোগানকে সামনে রেখে ভোটে বিশাল জয় পেয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, এই জয় রাজ্যের সর্বত্র শিল্পায়নের পক্ষে মানুষের রায়। কিন্তু সিঙ্গুরের মানুষের রায় অন্য ছিল (ওই কেন্দ্রে তৃণমূল জিতেছিল)। তাই তাঁদের সঙ্গে আগে কথা বলা উচিত ছিল। ওখানকার কৃষক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। জমি-প্রসঙ্গে তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পরে টাটাদের সঙ্গে কথা বললে ভাল হত।’’ কিন্তু নন্দীগ্রামে এক ইঞ্চি জমিও নেওয়া হয়নি, তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি ‘অন্য দিকে’ মোড় নিয়েছিল— এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইয়েচুরি বলেন, ‘‘আসলে তৃণমূল এবং মাওবাদীদের লক্ষ্য ছিল, যে ভাবেই হোক বামফ্রন্ট সরকারকে বিপাকে ফেলা। ওরা তা-ই করেছিল।’’
রাজ্য থেকে শুধু উচ্চশিক্ষিত তরুণ বা শ্রমিকের কাজ করার জন্য কৃষক-সন্তানেরাও এখন ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। কাজের সন্ধানে এই যুবকদের যাতে রাজ্যের বাইরে পা দিতে না হয়, জোট সরকার ক্ষমতায় এলে সেটাই নিশ্চিত করতে চান ইয়েচুরিরা। কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ ভাবে সরকার চালানোর পরিস্থিতি এলে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি করতে হবে। সেখানে কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নই হবে অগ্রাধিকার, বুঝিয়ে দিয়েছেন সিপিএমের কাণ্ডারী।
রাজ্যে শিল্প ও কর্মসংস্থানের অভাবেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সিন্ডিকেট-রাজ। তৃণমূল জমানায় সিন্ডিকেটের দাপট বাড়লেও সেই সমস্যা বাম আমলেও ছিল। তাঁরা ক্ষমতায় ফিরলে কী ভাবে এর মোকাবিলা করবেন, সেই প্রশ্নও ভাবতে হচ্ছে সিপিএমকে। ইয়েচুরি মেনে নিয়েছেন, তাঁদের সময়েও এই সমস্যা ছিল। যে কারণে অনেক দলীয় কর্মীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। তবে সমস্যার এমন প্রাবল্য ছিল না। ইয়েচুরির বক্তব্য, ‘‘এই নির্বাচন থেকে সকলকেই শিক্ষা নিতে হবে। মাফিয়া, সিন্ডিকেট দিয়ে সরকার চলে না। এরা আদর্শগত জায়গা থেকে দলে আসে না। যে ভাবেই হোক, এদের প্রবেশ রুখতেই হবে। কড়া হাতে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার জন্য কেরল শিবির-সহ দলের একাংশেরই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে ইয়েচুরিকে। আবার এ রাজ্যেও কেউ কেউ বলছেন, আরও আগে থেকে দু’দলের নেতৃত্ব কথা বলে জোট আরও মসৃণ করতে পারতেন। ইয়েচুরি অবশ্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, ‘‘কংগ্রেস এবং বামেদের মধ্যে কোনও জোট হয়নি। সাধারণ মানুষের চাপে দুই দলের মধ্যে আসন-রফা হয়েছে। ভোট-প্রক্রিয়া চলাকালীন তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের জোট হয়েছে। এটা যে হেতু নিচু তলার চাপে হয়েছে, আগে থেকে করা সম্ভব ছিল না।’’
কিন্তু যদি দিদিই ক্ষমতায় থেকে যান, তা হলে ‘ভাবের ঘরে চুরি’র জন্য তাঁকে কি কেরল-শিবিরের শক্ত প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না? ইয়েচুরির জবাব, ‘‘ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে ওখানকার নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি বলেছি। ওঁরা বুঝেছেন। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাম-কংগ্রেস কাছাকাছি এসেছে। তার সঙ্গে অন্য কিছু একসঙ্গে নিয়ে দেখা উচিত নয়।’’ এই প্রসঙ্গে ২০০৪-এ লোকসভা ভোটের পরে বিজেপি-কে রুখতে কংগ্রেসের সঙ্গে ইউপিএ-১ সরকার গঠন আবার সেই সময়েই কেরলে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই— এই দৃষ্টান্ত সামনে এনেছেন ইয়েচুরি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কেরলের নেতারা দেখেছেন কংগ্রেস যদি আমাদের উপরে নিভর্রশীল হয়, তা হলে কেরলে ফল ভাল হয়! সেই ২০০৬ সালে বিধানসভায় আমরা সর্বাধিক আসন জিতেছিলাম।’’