নির্বাচন কমিশন গর্জাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বর্ষাচ্ছেও। তবু সংশয় যাচ্ছে না জিয়াদুলদের!
দু’বছর আগেও সব ছিল। কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। পুলিশ ছিল। বুথে ছিল ক্যামেরা। ছিলেন মাইক্রো-অবজার্ভার। আর ছিল নির্বাচন কমিশনের আশ্বাস, ‘ভোট হবে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’।
তবু ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজের ভোট নিজে দিতে পারেননি হাওড়ার জয়পুরের ঝামাটিয়া গ্রামের জিয়াদুল মোল্লা। বুথে যাচ্ছিলেন। রাস্তার ধারে থাকা কড়া চাহনির যুবকেরা তাঁকে এই বলে ফিরিয়েছিল, ‘তোমার ভোট
হয়ে গিয়েছে’। এ বারও সব রয়েছে।
কেন্দ্রীয় বাহিনী সেই কবে থেকে এলাকায় টহল দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, ‘ভোট হবে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’। কমিশনের তরফ থেকে গড়া হয়েছে বুথ পর্যায়ের কমিটি (বিএলসি)। কমিটির সদস্যেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ভোট দেওয়ার আবেদনও জানাচ্ছেন। তবু প্রত্যয় হচ্ছে না জিয়াদুলের। নিজের ভোট কি নিজে দিতে পারবেন? ভোটের দিন নিরাপত্তা শুধু ফাঁকা বুলি হয়ে থেকে যাবে না তো!
জিয়াদুল পেশায় কাঠের মিস্ত্রি। আমতা বিধানসভা কেন্দ্রের ৬৭ নম্বর বুথের ভোটার। কমিশনের গড়া বিএলসি-র সদস্যেরা ইতিমধ্যে গ্রামে এসে তাঁর সঙ্গে কথাও বলেছেন। নিজের সংশয়ের কথা জিয়াদুল তাঁদের জানিয়েছেন। তাঁকে যে ভাবাচ্ছে ২০১৪!
কী হয়েছিল সে বার?
জিয়াদুলের ভোটকেন্দ্র ছিল ঝামটিয়া ধরমপোতা প্রাথমিক স্কুল। বুথটিকে ‘অতি স্পর্শকাতর’ ঘোষণা করা হয়েছিল। নির্বাচনের দিন সকাল থেকে বন্দুক উঁচিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাহারা দিচ্ছিল বুথের চৌহদ্দিতে। বাইরে ছিল পুলিশ। সকাল ৯টা নাগাদ ভোট দিতে বেরিয়েছিলেন জিয়াদুল। তার পরে? জিয়াদুলের স্মৃতি এখনও টাটকা, ‘‘বাড়ির সামনে রাস্তায় তৃণমূলের কিছু ছেলে পথ আটকাল। বলল, তোমার ভোট হয়ে গিয়েছে। কষ্ট করে আর বুথে যেতে হবে না। ওদের উগ্র মূর্তি দেখে আর পা বাড়াইনি।’’
একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওই বুথের আরও অনেক ভোটারের। যেমন বশির আহমেদ। তাঁর কথায়, ‘‘নিরাপত্তা নিয়ে কত কথা শুনেছিলাম! সব ছিল। শুধু আমাদের ভোট দেওয়ার অধিকারটাই যেন ছিল না!’’ গ্রামের আর এক কাঠের মিস্ত্রি শেখ আসাদুল আলির অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। তিনি বলেন, ‘‘ওই যুবকদের অনেকের হাতেই রিভলভার, ভোজালি ছিল। আমাকে বুথে যেতে বারণ করল। তাই ঝুঁকি নিইনি।’’
গ্রামবাসীদের অনেকেই জানান, সে বার সকালের ঘণ্টা দুয়েক ভোট দিতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু তার পরেই সব চৌপাট হয়ে যায়। বুথে যাওয়ার জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে তৃণমূলের ছেলেরা জটলা করতে থাকে। মুষ্টিমেয় কিছু চেনামুখ ছাড়া কাউকে তারা
বুথ পর্যন্ত যেতে দেয়নি। ওই মোড়গুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী আসেনি। পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়।
এই বুথে মোট ভোটার ৭৫২ জন। কমিশনের তথ্য বলছে, সে বার এই বুথে ভোট পড়েছিল ৩৯৪টি। এর মধ্যে কংগ্রেস, সিপিএম এবং বিজেপি পেয়েছিল যথাক্রমে ২৭, ২৯ এবং ৯টি ভোট। অন্যদিকে, তৃণমূল একাই পায় ৩২৯টি ভোট। ওই নির্বাচনে আমতা কেন্দ্রে শাসক ও বিরোধীদের প্রাপ্ত ভোটের বেনজির ব্যবধান দেখা গিয়েছে আরও কয়েকটি বুথে। জিয়াদুল, বশির, আসাদুলদের ক্ষোভ, ‘‘আমাদের আটকে দেওয়া হলেও ভোট তো পড়েছে। তা-ও আবার পেয়েছে তৃণমূল। তা-হলেই বুঝে নিন আমাদের হয়ে কারা ভোট দিয়েছিল এবং কী ভাবে দিয়েছিল!’’
এ বার তেমন কিছু না হওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে জেলা প্রশাসন। হাওড়ায় ভোট আগামী ২৫ এপ্রিল। সে জন্য শনিবার পুলিশ সুপার, পুলিশ কমিশনার এবং বিশেষ পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে ন’টি স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা করেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। জেলাশাসক তথা রিটার্নিং অফিসার শুভাঞ্জন দাস জানিয়েছেন, এ বার বুথের ৩০০ গজের বাইরেও কোনও রকম বিশৃঙ্খলা, জটলা বা ভোটারকে ভয় দেখানোর চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার জন্যই বৈঠক হয়। যে যে বুথের বাইরে গোলমালের আশঙ্কার কথা ওই নেতারা জানাবেন, সেগুলি ‘নোট’ করে নেওয়া হবে। সেখানে ভোটের আগের দিন থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী লাগাতার রুটমার্চ করবে।
কমিশনের এই সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছে বিরোধী দলগুলি। তারা মনে করছে, এতে মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন। পক্ষান্তরে, আমতা বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল সভাপতি সেলিমুল আলমের দাবি, ‘‘সে বারও মানুষ নিজের ভোট
নিজে দিয়েছিলেন। এ বারেও পারবেন। বিরোধীরা মিথ্যা অভিযোগ তোলা বন্ধ করুক।’’ জিয়াদুলরা বলছেন, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।