গুছিয়ে এগোচ্ছে ‘ভূতেরা’, এখনও ওঝা হয়ে উঠতে পারেনি কমিশন

দৃশ্য-১: নানুর বিধানসভা কেন্দ্র। কসবা বাজারে প্রচারে আসছেন এলাকার বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারেও তৃণমূলের প্রার্থী গদাধর হাজরা। গোটা দশেক গ্রামের লোককে জড়ো করে মিছিলের বহর দেখার মতো করে তুলতে হবে। নির্দেশ রয়েছে কেষ্টদা’র। লোক জড়ো করার তাগিদে ভোর থেকে গ্রামগুলো এমন ভাবে চষে ফেলছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা, যেন গদাধর নয়, স্বয়ং দলনেত্রী আসছেন।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১৯
Share:

দাপুটে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্টদা।—ফাইল চিত্র।

দৃশ্য-১: নানুর বিধানসভা কেন্দ্র। কসবা বাজারে প্রচারে আসছেন এলাকার বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারেও তৃণমূলের প্রার্থী গদাধর হাজরা। গোটা দশেক গ্রামের লোককে জড়ো করে মিছিলের বহর দেখার মতো করে তুলতে হবে। নির্দেশ রয়েছে কেষ্টদা’র। লোক জড়ো করার তাগিদে ভোর থেকে গ্রামগুলো এমন ভাবে চষে ফেলছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা, যেন গদাধর নয়, স্বয়ং দলনেত্রী আসছেন। গদাধরকে নিয়ে এত তৎপরতা কেন? দলে গদাধরের ঘোর বিরোধী বলে পরিচিত কাজল শেখ গোষ্ঠীর এক জন ফিসফিস করে বললেন, ‘‘ব্যস্ততা আজ ভোর থেকে নয়। কয়েক দিন ধরে দিন-রাত এক করে মিছিলের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বলেছে, মিছিলে মুখ দেখালেই, ভোটের পর ইন্দিরা আবাসে বাড়ির বন্দোবস্ত পাকা।’’

Advertisement

দৃশ্য-২: পাঁড়ুই থানা এলাকা। গ্রাম মাখড়া। গ্রামের সব টিউবওয়েল খারাপ। কিন্তু টিউবওয়েল সারানোর কোনও আগ্রহই নেই স্থানীয় প্রশাসনের। গ্রামের লোকজন চাঁদা তুলে দু’একখানা কল অস্থায়ী ভাবে সোজা করেছিলেন বটে। গোটা গ্রামের জল জোগানোর চাপ সইতে না পেরে তারাও আবার বিকল। কী ব্যাপার? ভোটের মুখে কল সারাই করে কাজ দেখানোর সুযোগ পেয়েও কেন হাতছাড়া করছে শাসক দল? এ বার আর ফিসফিস নয়। জোর গলাতেই লোকজন বললেন, ‘‘বিরোধী দলে ভোট দিলে কোনও কাজ হবে না মাখড়ায়। জানিয়ে দিয়েছেন চন্দ্রনাথ সিংহ, অনুব্রত মণ্ডল। জল বিনা মরতে বলেছে আমাদের।’’

দৃশ্য-৩: বছরখানেক আগেও তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে অশান্ত থাকা চৌমণ্ডলপুর গ্রাম। ১০০ দিনের কাজের টাকা পাননি গ্রামের বহু শ্রমিক। কবে পাওয়া যাবে? গ্রামবাসীদের দাবি, আগে শোনা গিয়েছিল, ভোটের আগে সব মিটিয়ে দেবে। এখন নেতারা বলছেন, ভোট মিটলে তবেই টাকা মিটবে। চৌমণ্ডলপুর থেকে তৃণমূল প্রার্থী যেন ভাল মার্জিনে লিড পান। না হলে ১০০ দিনের কাজের টাকা ‘মায়ের ভোগে’ যেতে পারে। এমনই নাকি জানিয়ে গিয়েছেন নেতারা।

Advertisement

দৃশ্য-৪: ইলামবাজার থানা এলাকার একটি আদিবাসী গ্রাম। ভোট প্রচারে কিছু দিন এলাকায় ঘোরার পর আদিবাসী মহিলাদের নিয়ে একটা মিটিং ডেকেছিল স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। মহিলাদের বলা হয়েছে, লোন পাইয়ে দেওয়া হবে। তার জন্য ভোটার পরিচয়পত্র চাই। আদিবাসী পল্লী জমা দিয়ে দিয়েছে ভোটার পরিচয় পত্র। কিন্তু কবে লোন মিলবে, আর কবে ভোটার কার্ড ফেরত পাওয়া যাবে, তা এখন আর জানা যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে ভোট মিটলে তবেই লোন। তার পর মিলবে কার্ড।


মহম্মদবাজারের ভুতুড়া অঞ্চলে সাঁইথিয়ার তৃণমূল প্রার্থী
নীলাবতীর সাহার হয়ে প্রচারে লাভপুরের প্রার্থী মনিরুল ইসলাম।

দাপুটে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্টদার রাজত্বে এমন ভাবেই ভোটের দিকে এগোচ্ছে বীরভূম। কেন্দ্রীয় বাহিনী ভোট গ্রহণের এক মাস বা তারও আগে হাজির। নির্বাচন কমিশন বারবার কড়া কড়া কথা শুনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে, আঁটুনি এ বার বজ্রের মতো। কিন্তু গেরো ফস্কানোর কাজ যে কী পদ্ধতিতে চলছে, বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে কয়েক রাত না কাটালে কারও পক্ষেই তা বোঝা সহজ নয়। বীরভূমে সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য গৌতম ঘোষ বললেন, ‘‘প্রথমে একটু লোভ দেখাচ্ছে। কাজ না হলে হুমকি দিচ্ছে। সে সব উপেক্ষা করেও যাঁরা পথে নামছেন, তাঁদের উপর চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। আর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ভোটার কার্ড কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া তৃণমূল চালু করে দিয়েছে। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময়ও এটা ওরা করেছিল। নিজেদের ভোটারদের অনেককেও বিশ্বাস করতে পারেনি। তাঁদের কার্ডও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এ বারও সেই পথে এগোচ্ছে।’’

লাভপুরে দিনকয়েক আগে কোনও রাখঢাক না রেখে সিপিএম সমর্থকদের বাড়িতে সরাসরি হামলা চালিয়েছে মনিরুল ইসলামের বাহিনী। কয়েক জনকে রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ির দাওয়ায় পড়ে কাতরাতে বাধ্য করা হয়েছে। হাসপাতালেও নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি দীর্ঘক্ষণ। বীরভূমের নেতাদের মধ্যে দলনেত্রীর খুব কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিতি এক প্রৌঢ় নেতা বললেন, ‘‘মনিরুল তো ভুল করেছে। এ সব মোটা দাগের কাজ কেউ করে নাকি। সবার চোখে পড়ে যায়। হইচই হয়। পাবলিক রিঅ্যাকশন হয়। প্রশাসনকে বাধ্য হয়ে কিছু না কিছু পদক্ষেপ করতে হয়। যে রকম ভাবে গুছিয়ে নিয়ে আমরা এগোচ্ছি, তাতে এ সব করার কোনও প্রয়োজনই নেই।’’ আর অনুব্রত মণ্ডল বললেন, ‘‘আমার কোনও দাপট নেই। যা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন। বীরভূম জেলাকে তিনি উন্নয়ন দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন। সেই জন্যই সংগঠন আজ এই জায়গায় গিয়েছে।’’

এই সংক্রান্ত ভিডিও দেখুন
ভোটের বীরভূমে ‘ভূত’-এর পোয়াবারো?

তৃণমূলের এই গুছিয়ে এগোনো কী শুধু বীরভূমে? মোটেই না। প্রথম দফার ভোট হয়ে গিয়েছে যে জঙ্গলমহলে, সেখানেও গুছিয়েই এগনো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় বাহিনী এলাকায় ঢোকার পর প্রথম কিছু দিন টহলদারি চলে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে কোনও অশান্তি চোখে না পড়ায়, ভোটের মুখে আর তেমন তৎপরতা দেখায়নি কমিশন। ফলে ভোটের আগের রাতে হাতে হাতে টাকা গুঁজে দেওয়া, মাংস-ভাত আর পানীয়ের আসর বসানো, ভোটের সকালে মুড়ি-চানাচুর আর গাড়ির বন্দোবস্ত করা— ভোট গুছিয়ে নিয়ে ঝুলিতে পোরার এমন নানা কারবার চলেছে অবাধেই। এখন উত্তর ২৪ পরগনার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে মুর্শিদাবাদের বিড়ি তালুক, ডুয়ার্সের চা বাগান এলাকা থেকে আসানসোল-দুর্গাপুরের শিল্পাঞ্চল, পূর্ব মেদিনীপুরের মৎস্যজীবী গ্রাম থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আয়লা দুর্গত এলাকা, সর্বত্র চলছে একই ব্যবস্থা। প্রথমে প্রলোভন দেখানো। কাজ না হলে যৎসামান্য কিছু পাইয়ে দেওয়া এবং আশ্বাস দেওয়া, ভোটের পর আরও মিলবে। তাতেও কাজ না হলে, হুমকি, জল বন্ধ করে দেওয়া, মজুরি খেটে পাওনা টাকা আটকে দেওয়া। তাতেও নিশ্চিন্ত না হতে পারলে কৌশলে বা গায়ের জোরে ভোটার কার্ড কেড়ে নেওয়া। কার্ড না কাড়া গেলে শাসানি— ভোট মিটলে কেন্দ্রীয় বাহিনী কিন্তু থাকবে না, আমরাই থাকব।

শাসানি যে সব সময় লুকিয়ে লুকিয়ে চলছে, তেমনও নয়। কখনও সাংসদ ভাইপো মঞ্চে উঠে বলছেন ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব, কখনও দলনেত্রী পিসি গলার স্বর সাত পর্দা চড়িয়ে বলে দিচ্ছেন, ভোট মিটলেই কড়ায় গণ্ডায় হিসেব বুঝে নেওয়া হবে। কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ থেকে বিজেপির বিদায়ী বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য, সবার গলায় একই সুর— এর পরও কী বোঝা যাচ্ছে না, অবাধ ভোট হতে দেওয়ার কোনও ইচ্ছা রাজ্য প্রশাসন তথা শাসক দলের নেই! বিজেপি নেতারা আশাবাদী যে নির্বাচন কমিশন রাশ টেনে ধরবেই। বাম-কংগ্রেস বলছে, কমিশন ধরতেই পারছে না রোগটা আসলে কোথায়। জোট নেতাদের দাবি, রাজ্য প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে স্বাধীন ভাবে কমিশনের কর্তাদের নির্দেশে কাজ করতে হবে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। তবেই পৌঁছনো যাবে ‘ভূতের আড্ডা’য়। আর ভূতের আড্ডায় পৌঁছনো না গেলে, ভোটের ভবিষ্যত ভুতুড়ে ভোটারদের হাতেই যাবে।

আরও পড়ুন
লালমাটিতে গেরুয়া ঝড় তুলে দিয়েছেন ‘দিদি’, কঠিন চ্যালেঞ্জে অনুব্রত

বিজ্ঞানসম্মত (সায়েন্টিফিক) রিগিং-এর অভিযোগ এক কালে শোনা যেত এই বাংলার বিরোধী নেত্রীর মুখে। এখন তিনি বিরোধী আসনে নেই। বিজ্ঞানসম্মত রিগিং-এর অভিযোগও আর নেই। বিরোধা জোটের কটাক্ষ, সমস্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে উঠে এ রাজ্যে রিগিং এখন ভৌতিক। অতএব, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাই নির্ধারণ করবে, বাংলার ভবিষ্যৎ এখন ভোটের হাতে, নাকি ভূতের হাতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement