গনি-হীন তালুকের জিওন কাঠি এখনও সেই গনি

তিনি কি অবিনশ্বর! দশ বছর কেটে গিয়েছে, তিনি নেই। কিন্তু ভোট এলেই মালদহে তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এ বারও তার ব্যতিক্রম নয়।

Advertisement

সঞ্জয় সিংহ

মালদহ শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১১
Share:

তিনি কি অবিনশ্বর! দশ বছর কেটে গিয়েছে, তিনি নেই। কিন্তু ভোট এলেই মালদহে তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এ বারও তার ব্যতিক্রম নয়।

Advertisement

তিনি আবু বরকত আতাউর গনিখান চৌধুরী।

কংগ্রেস প্রার্থীরা তো বরাবরই হয় তাঁর পরিবারের সদস্য, নয় পরিবারের স্নেহধন্য। এ বার সে দিকে হাত বাড়িয়েছে তৃণমূলও। গনির এক ভাই ও এক ভাগ্নিকে প্রার্থী করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রার্থী করেছেন একদা তাঁর ঘনিষ্ঠ মোয়াজ্জেম হোসেনকেও।

Advertisement

তাই কোতুয়ালির বাড়ি এখন দুই শিবিরেরই ‘ওয়ার রুম’।

সকাল থেকেই সেখানে সাজ সাজ রব। বাড়ির সামনে অপেক্ষায় ভিড় করে দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকেরা। কখন কে বের হন! এই হয়তো ‘স্করপিও’ নিয়ে ঝড়ের গতিতে বার হলেন গনির ভাগ্নি, কংগ্রেসের জেলা সভাপতি মৌসম বেনজির নূর। গাড়ি ছুটল প্রচারে। পরক্ষণেই বার হয়ে গেল তাঁর দিদি, তৃণমূল প্রার্থী শেহনাজ কাদরির ‘বোলেরো’। আবার সকালে কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরীর (ডালুবাবু) ছেলে ইশা খানের ‘স্করপিও’ গিয়েছে সুজাপুরের দিকে। বেলা বাড়ার খানিক পরে আবু নাসের খান চৌধুরীর (লেবুবাবু) ‘বোলেরো’-ও গেল সুজাপুরের দিকেই। কাকা-ভাইপোর লড়াইয়ে এর মধ্যেই জমজমাট ওই কেন্দ্র। এরই মধ্যে ‘জাইলো’য় চেপে ইংরেজবাজারের দিকে ছুটলেন ডালুবাবু।

কোনটা কার পক্ষের গাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। ডালুবাবুদের গাড়িতে কংগ্রেসের পতাকা আর সিপিএমের লাল ঝাণ্ডা বাঁধা। কাদরির কটাক্ষ, ‘‘কোতুয়ালির বাড়ি থেকে সিপিএমের লাল পতাকা বেঁধে গাড়ি বেরোচ্ছে, ভাবা যায়!’’ জবাবে মৌসুম বলেন, ‘‘আর তৃণমূলের লোকেরা যে বলছে বরকতের বাড়িতে তালা লাগিয়ে দেব! তার বেলা!’’

গনির উত্তরাধিকার নিয়ে বাগযুদ্ধ অবশ্য শুধু কোতুয়ালিতেই আটকে নেই। প্রচারে এসে মমতা এবং সনিয়া গাঁধী, দু’জনেই কবর খুঁড়ে তুলে এনেছেন গনির নাম। গত ৪ এপ্রিল কালিয়াচকের সভায় মমতা বলেছেন, ‘‘বরকতদা বেঁচে থাকলে ‘বিশ্বাসঘাতকদের’ (বামের সঙ্গে জোট করার ব্যাপারে অগ্রণী কংগ্রেস নেতানেত্রীদের) ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতেন।’’ এর এক সপ্তাহ পরে সুজাপুরের সভা থেকে এর জবাব দিয়েছেন সনিয়া, ‘‘আজ পশ্চিমবঙ্গে যা কিছু হচ্ছে তা বরকতদা পছন্দ করতেন না।’’

অঙ্কের হিসেবে মালদহের ১২টি আসনের সব ক’টিতেই জোটের থেকে পিছনে রয়েছে তৃণমূল। এমনকী, ইংরেজবাজারেও। ২০১১ সালে এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছিলেন কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। পরে দল বদলে তৃণমূলে যান তিনি। এবং উপনির্বাচনে জিতে মন্ত্রীও হন (তার পরে অবশ্য তাঁর এবং আর এক তৃণমূল মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের ঝগড়া অন্য সব বিষয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে)। ‘‘সে সব কোন কালের কথা! তখন তো জোট ছিল না,’’ বলছেন কোতুয়ালির বাইরে ভিড় করে থাকা লোকজনেরাই। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি। তখন কিন্তু তৃণমূল ছিল তিন নম্বরে। সেই নির্বাচনেও কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের মোট ভোট ছিল শাসক দলের থেকে অনেকটাই বেশি।

এমন নড়বড়ে উইকেটে তাই গনির শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না তৃণমূল নেতৃত্বের। সেটা বলছেন লেবুবাবু, শেহনাজ কাদরিরাই। কাদরির কথায়, ‘‘রতুয়ায় কংগ্রেসের শক্ত ভিত ভাঙতে গেলে আমার মতো গনি পরিবারের সদস্য এবং সংখ্যালঘু প্রতিনিধি-ই দরকার ছিল।’’ লেবুবাবুর একই কথা— সুজাপুরে কংগ্রেসকে আটকাতে তাঁর মতো গনি পরিবারের কাউকে দাঁড়াতেই হতো। যদিও শেষ মুহূর্তে ইশাকে তাঁর সামনে ঠেলে দিয়ে তাঁর যুদ্ধ কঠিন করে দিয়েছেন তাঁরই ভাই ডালুবাবু। আর সেটাকে নিয়ে গিয়েছেন সোজা কোতুয়ালির অন্দরে। তাতে খানিক বিব্রতই লেবুবাবু। মুখে হাসি ঝুলিয়ে প্রচারে যাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু তিনিই কি দাদা গনির সত্যিকারের উত্তরাধিকারী, নাকি কংগ্রেস সংসার ছাড়ায় মালদহের মানুষের কোপে পড়বেন— এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন সযত্নে। আর এমন প্রশ্ন ওঠার আগেই ইশার বাবা ডালুবাবু বলছেন, ‘‘গনিখানের পরিবার মানে কংগ্রেসের ‘হাত’। শুধু সুজাপুরই নয়, গোটা মালদহই সেটা জানে।’’ এই কোতুয়ালি থেকেই গোটা জেলার ভোট সামলাচ্ছেন কংগ্রেস জেলা সভাপতি মৌসম। তাঁর একটাই কথা, বিশ্বাসঘাতক কে, সেটা ভোটবাক্সেই বুঝিয়ে দেবেন মালদহের মানুষ।

যে বরকতের সঙ্গে আজীবন লড়াই করে এসেছে সিপিএম, এ বারে তাঁর ছায়াকে পাশে পেয়ে গলায় আলাদা জোর তাদের লোকজনের। এবং এই ছায়াকে যে অস্বীকার করা যাচ্ছে না এখনও, মেনে নিয়েছেন তা-ও। সিপিএম জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র থেকে দলের নেতা জীবন মৈত্র, সকলেই একই কথা বলছেন। আর বলছেন, এটা কংগ্রেস আর বামেদের জেলা। এখানে তৃণমূল শূন্য পাবে।

গনির হাওয়া পালে লাগাতে মরিয়া তৃণমূল জেলা নেতৃত্বও এই নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। নিজেকে ‘গনির আদর্শ শিষ্য’ বলে প্রচার করেন যে মোয়াজ্জেম, তিনি জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘আমরা লড়াইয়ের মধ্যে আছি। কারণ গনি খানের জেলা কংগ্রেস-সিপিএম জোট মেনে
নেয়নি। আর মমতাদির উন্নয়নের ছোঁয়া তো আছেই।’’

সত্যিই কি তাই? শুনে হাসছেন কংগ্রেস সাংসদ ডালুবাবু। হাসছেন মৌসম। আড়ালে কি হাসছেন গনি খানও?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement