ধৃত নান্টু প্রধান শুক্রবার কাঁথি আদালতে (ডোরাকাটা টি শার্ট)। তাঁরই মায়ের নামে শেখবাড় গ্রামে কয়েক একর জমি জুড়ে তৈরি হচ্ছে বিএড কলেজ। ছবি: সোহম গুহ।
এলাকায় তিনিই ‘সরকার’।
অভিযোগ, কেউ হুকিং করলে টাকা দিতে হয় তাঁকে।
মাছের ভেড়ির ব্যবসা চালাতেও নাকি তাঁকে দিতে হয় নজরানা।
এমনকী থানায় অভিযোগ জানানোর আগেও তাঁর কাছেই যেতে হয় বলে দাবি গ্রামবাসীর। তিনি বিচার করে রায় দিলে তা মাথা পেতে নিতে হয়। আর তিনি যদি মনে করেন বিষয়টি পুলিশের খাতায় তোলা দরকার, তবেই পুলিশ আসে।
ভোটের মুখে শাসক দলের এ হেন ‘দাদা’ পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর ব্লকের মহম্মদপুর ১ পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান নান্টু প্রধান গেলেন শ্রীঘরে। যা দেখে বিরোধীরা বলছেন, কমিশনের ঠ্যালাতেই পুলিশের এই ভোল বদল। যদিও পুলিশ কর্মীদের একাংশের ব্যাখ্যা, শুধু কমিশনের গুঁতো নয়, ভোটের ফলের
আগাম আভাস পেয়ে বদলাচ্ছেন পুলিশ কর্তাদের একাংশও। ভোট-মরসুমে উত্তর ২৪ পরগনা, বিধাননগরে পুলিশের ভূমিকা দেখে তাই সরব হয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
শাসক দলের দাপুটে নেতা নান্টুর বিরুদ্ধে পরিবর্তনের জমানায় কম অভিযোগ ওঠেনি। পঞ্চায়েতে দুর্নীতি, তোলাবাজি থেকে শুরু করে সেচ দফতরের আধিকারিকদের মারধর করে কেলেঘাই-কপালেশ্বরী নদী সংস্কার প্রকল্পের কাজ থমকে দেওয়া, বেনামে ঠিকাদারি ব্যবসা, ডাকাতি— অভিযোগের পাহাড় জমলেও বহাল তবিয়তে ছিলেন নান্টু। এমনকী গত ২ মার্চ একশো দিনের কাজের বকেয়া মজুরির দাবিতে স্মারকলিপি দিতে এসে ব্লক অফিসে ভাঙচুর, প্রশাসনিক আধিকারিকদের মারধরের ঘটনায় নান্টুর নাম জড়ানোর পরেও হাত গুটিয়ে ছিল পুলিশ। ১২ জন ধরা পড়লেও ছোঁয়া যায়নি নান্টুকে।
কিন্তু এখন জেলার দোরগোড়ায় ভোট। ৫ মে ভোটের সপ্তাহখানেক আগে তাই ব্লক অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় জেলা পুলিশই নান্টু-সহ ৬ জনকে গ্রেফতার করল। বৃহস্পতিবার রাতে ওড়িশার কটকের মঙ্গলবাগ এলাকার একটি হোটেল থেকে তাদের পাকড়াও করা হয়। খুনের চেষ্টা-সহ একাধিক ধারায় অভিযুক্ত ৬ জনকেই শুক্রবার জেল হেফাজতে পাঠিয়েছে কাঁথি আদালত। তবে নান্টু-সহ দু’জনকে হেফাজতে চেয়ে আবেদন জানিয়েছে পুলিশ। আজ, শনিবার তার শুনানি হবে।
গোটা ঘটনায় সামনে এসেছে পুলিশ-প্রশাসনের অন্দরে তৃণমূলের এই সব ‘দাদা’দের অবাধ যাতায়াতের ছবিও। পুলিশের ঘরের কথা নান্টুর কানে তোলায় মামলা রুজু হয়েছে ভগবানপুর থানার সিভিক ভলান্টিয়ার গোকুল মিদ্যার বিরুদ্ধে। সিভিক ভলান্টিয়াররা রাজ্যের নানা প্রান্তে তৃণমূলের হয়ে কাজ করছে বলে বরাবর সরব বিরোধীরা। বৃহস্পতিবারই বাঁকুড়া জেলায় সিভিক পুলিশ নিয়োগ নিয়ে দায়ের করা এক মামলার শুনানিতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ ছিল— রাজ্য জুড়ে সিভিক পুলিশ নিয়োগে বড়সড় কেলেঙ্কারি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এক সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে তৃণমূল উপপ্রধানকে ফোন করে পুলিশের গতিবিধি জানানোর অভিযোগ ওঠায় অস্বস্তিতে বেড়েছে শাসক দলের।
ভোটের আগে নান্টু চণ্ডীপুর বিধানসভা এলাকায় সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করতে পারেন বলে ক’দিন ধরেই পুলিশ-প্রশাসনে নালিশ জানাচ্ছিলেন বিরোধীরা। সেই নান্টু ধরা পড়ায় বিরোধী শিবির খুশি। চণ্ডীপুরের জোট প্রার্থী সিপিএমের মঙ্গলেন্দু প্রধান এ দিন বলেন, ‘‘নান্টু গ্রেফতার হওয়ায় এলাকার মানুষ স্বস্তি ফিরে পেলেন। এ বার ভোটটা যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয় প্রশাসনকে সেটা দেখতে হবে।’’ অন্য দিকে তৃণমূল নেতৃত্ব নান্টু-পর্ব এড়িয়ে যেতে চাইছেন। দলের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সভাপতি শিশির অধিকারী শুধু বলেন, ‘‘কারও বিরুদ্ধে যদি কোনও অভিযোগ থাকে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’’ একই সুর শোনা গিয়েছে চণ্ডীপুরের তৃণমূল প্রার্থী অমিয়কান্তি ভট্টাচার্যের গলাতেও।
নেতারা যা-ই বলুন, তৃণমূলেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, দলের জেলা নেতাদের ‘প্রশ্রয়ে’ গোটা মহম্মদপুরে একচ্ছত্র দাপট চলে নান্টুর। সিভিক ভলান্টিয়ার, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী, এমনকী প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগেও কাজে আসে তাঁর সুপারিশ। ২০১৩ সালে গোকুলের সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরির পাওয়ার ক্ষেত্রে নান্টুর ভূমিকা ছিল বলেই খবর। সেই সূত্রে দু’জনের যোগাযোগ। তবে গোকুলকে এখনও ধরেনি পুলিশ।
শুক্রবার মহম্মদপুর ২ পঞ্চায়েতের দনাইপুর গ্রামের বাড়িতেই দেখা মিলল গোকুলের। আপনি কি সত্যিই সব খবর নান্টুকে দিচ্ছিলেন? সদুত্তর এড়িয়ে গোকুলের জবাব, ‘‘নান্টুবাবু আমার পরিচিত। বিভিন্ন নম্বর থেকে আমার মোবাইলে ফোন আসে। সেই নম্বর নান্টুবাবুর কিনা, তা আমার জানা নেই।’’ তবে পুলিশ সূত্রের খবর, সম্প্রতি নান্টুকে ধরতে জেলা পুলিশের একটি ‘স্পেশ্যাল টিম’ গড়া হয়েছিল। সেই দলের গতিবিধির খবর গোকুল মারফত নান্টুর কাছে পৌঁছত বলে অভিযোগ। গোকুলকে ভগবানপুর থানার পুলিশ এ নিয়ে জি়জ্ঞাসাবাদও করে। কিন্তু কেন গোকুলকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না? জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার জবাব, ‘‘ওই সিভিক ভলান্টিয়ার অভিযুক্তদের বাঁচাতে সাহায্য করছিলেন। ওঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। আমরা শিগগিরি ওঁকে ধরে ফেলব।’’
স্থানীয় সূত্রে খবর, বাবার হাত ধরেই নান্টুর রাজনীতিতে আসা। ২০০৩ সালে তৃণমূলের টিকিটে জিতে মহম্মদপুর-১ পঞ্চায়েতের প্রধান হন নান্টুর বাবা চাঁদহরি প্রধান। ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটানা ওই পদে ছিলেন তিনি। রাজ্যে পালাবদল হওয়ায় মহম্মদপুরের শেখবাড় গ্রামের এই প্রধান পরিবারের দাপট বাড়ে। নান্টু ভোটে জিতে উপপ্রধান হন। স্ত্রী অপর্ণা হন পঞ্চায়েতের প্রধান। আর নান্টুর ভাই পিন্টু ভগবানপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ। নান্টুর শাশুড়িও পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য।
এই ‘পঞ্চায়েত-রাজ’ কায়েমের পরই রাতারাতি বদলে যায় নান্টুর জীবন। বছর ছত্রিশের যে যুবক একটা সময় কুয়োর চারদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়ার কাজ করতেন, তাঁরই এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ। দো’তলা বাড়ি, দোরগোড়ায় গাড়ি। বেশ কয়েক একর জমিতে মায়ের নামে পেল্লায় বিএড কলেজও বানাচ্ছেন নান্টু। এ দিন বাড়িতে গিয়ে শুধু দেখা মিলল নান্টুর মা আশালতাদেবীর। ছেলের গ্রেফতারের খবর জানলেও তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না প্রৌঢ়া। শুধু বললেন, ‘‘নান্টু মোটরবাইক থেকে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিল। তাই কটকে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিল।’’
এলাকাবাসীও তেমন মুখ খুললেন না। তবে নান্টুর গ্রেফতারিতে কপালে ভাঁজ স্থানীয় নেতাদের। তাঁদেরই এক জন মানলেন, ‘‘নান্টু ধরা পড়ায় ভোট করানোটা চাপ হয়ে গেল।’’