খেলাটা শুরু হয়ে গিয়েছে। ভোটের আগের খেলা।
আজ, সোমবার ভোটের আগে তাই প্রমাদ গুনছে বাঁকুড়ার বিরোধী দলগুলি। এ খেলা হুমকির খেলা। ভোটে শুরুর আগেই বাছাই ভোটারদের দাবড়ে দেওয়ার খেলা— বিরোধী দলের সমর্থক হলে বুথে যাওয়ার আগেই আটকে দেওয়া হবে। বেশি সাহস দেখাতে গেলে জুটতে পারে মারধরও! কোথাও হুমকি, কোথাও টাকা পয়সা ছড়ানো, কোথাও সিপিএম কর্মীকে মেরে হাত ভেঙে দেওয়া— শুধু শনিবারের রাতেই এমন নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে বাঁকুড়ার একাধিক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। বুথে অশান্তি ঠেকাতে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন বিরোধীরা। তাঁদের আশঙ্কা, রবিবার রাতেও হুমকি-শাসানি-মারধর অব্যাহত থাকবে। যাতে, ভোটের আগেই বিরোধী ভোটারদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
হাড় ভেঙে দেবো
বিষ্ণুপুর কেন্দ্রের রাজপুর মুসলিমপাড়ার গোটা পঁচিশ পরিবারকে শনিবার রাতে তৃণমূলের লোকজন হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ। বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, তাঁরা কোনও পার্টি করেন না। কিন্তু তৃণমূলের ছেলেরা তাঁদের কংগ্রেসের ভোটার বলে চিহ্নিত করেছে। রাতে জনা পাঁচেক তৃণমূলের ছেলে দরজায় টোকা মেরে শাসানি দিয়েছে, ‘যদি সোমবার বুথে তোদের দেখি, মেরে হাড় ভেঙে দেব। এমন মারব যে, তোদের খাটিয়ায় করে তুলে আনতে হবে! জেনে রাখ, তোদের ভোট হয়ে যাবে। ওই দিকের পথ মাড়াবি না’।
সত্যিই ভাঙল হাড়
সিপিএমের নির্বাচনী এজেন্টকে মেরে হাতই ভেঙে দেওয়া হল সোনামুখী কেন্দ্রের অন্তর্গত পাত্রসায়র থানার নতুনবাজারে। রবিবার সকালে সাধন বাগদি নামে ওই প্রৌঢ় সিপিএম নেতাকে রাস্তায় ফেলে রড, লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। তিনি বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি। তাঁর ছেলে তৃণমূলের নির্বাচনী এজেন্ট সুব্রত ওরফে গোপে দত্ত-সহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। সোনামুখীর সিপিএম প্রার্থী অজিত রায়ের অভিযোগ, “মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারলে বিদায়ী বিধায়ক দীপালি সাহা এ বার হারবেন। এটা বুঝতে পেরেই আক্রমণ।’’ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দীপালিদেবী।
টাকা উড়বে
বিরোধীদের বেশি আশঙ্কা, বিষ্ণুপুর ও সোনামুখী নিয়ে। প্রথমটিতে তৃণমূলের প্রার্থী বিদায়ী মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয়টিতে, শ্যামবাবুর ঘনিষ্ঠ দীপালি সাহা। লোকসভা ভোটের সময় এই দীপালিদেবীর বিরুদ্ধেই বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর করে ভোট লুঠের অভিযোগ উঠেছিল। তাঁর হয়ে আইনি লড়াই লড়েছিলেন শ্যামবাবুই। জেলা সিপিএমের এক নেতার দাবি, ‘‘বিষ্ণুপুর শহরের বস্তি এলাকা এবং শহর লাগোয়া কিছু গ্রামে তৃণমূল টাকা ছড়াচ্ছে। ভোটের আগের রাতে তা আরও বেশি হবে।’’
খাঁচার মুরগি গায়েব
কংগ্রেসের হয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচারে গিয়েছিলেন বিষ্ণুপুর কেন্দ্রের মেটাপাতন গ্রামের বাসিন্দা সুখী হেমব্রম। আত্মীয় বাড়ি থেকে শনিবার রাতে বাড়ি ফিরে দেখেন, উঠোনের আম ও পেঁপে গাছ কাটা। খাঁচায় রেখে যাওয়া মুরগিগুলোও নেই। অভিযোগ, এই নিয়ে প্রতিবাদ করায় গ্রামের কিছু তৃণমূল কর্মী এসে সুখীদেবী ও তাঁর স্বামীকে মারতে মারতে গ্রামছাড়া করে। ওই দম্পতি গিয়ে ওঠেন রাধানগরের কংগ্রেস নেতা দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। রাতে দীনবন্ধুবাবু তাঁদের ফের বাড়িতে দিয়ে যান। সুখীদেবীর আশঙ্কা, “পুলিশ অভিযোগ নিয়েছে। তবু ভয়ে আছি। ভোট দিতে গেলেও যদি হামলা হয়!”
মিটিং করলেন কে
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্রের দাবি, শনিবার তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা জেলায় এসে নির্দেশ দিয়েছেন, বেশি বাড়াবাড়ি নয়। প্রত্যন্ত এলাকার কিছু বুথকে বেছে নেওয়া হয়েছে ভোটের দিন ভূতের উপদ্রবের জন্য। তৃণমূল অবশ্য এই দাবিকে ‘সিপিএমের আষাড়ে গপ্পো’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
বাঁকুড়ার জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসুর আশ্বাস, ‘‘নির্বিঘ্নে ভোট সম্পন্ন করাই আমাদের লক্ষ্য। ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগে যাতে কোনও বাধা না আসে, সেটা দেখাই আমাদের দায়িত্ব। এই কাজ করতে যা করার আমরা করব।’’ প্রত্যন্ত গ্রামের ভোটারেরাও যাতে নির্ভয়ে বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারেন, এ বার কমিশন নিশ্চিত করবে সেটাই— এই আশ্বাস বারবার দিয়েছে নির্বাচন কমিশনও।
তবু, ভূতের খেলা তো! ভূত যে নিরাকার। বাংলার ভোটতন্ত্রে পুলিশ-প্রশাসন-কেন্দ্রীয় বাহিনী, কেউই তাই ভূতেদের দেখতে পায় না!
(সহ প্রতিবেদন: দেবব্রত দাস)