পঞ্চায়েত ভোটে নির্দল প্রার্থীদের বাড়ি জ্বালানোর কথা বলেছিলেন, পুলিশকে বোম মারার কথা বলেছিলেন। তার পরেও তাঁর টিকি ছুঁতে পারেনি কেউ। বিধানসভা ভোট শুরু হতেই কখনও ভোটারদের হুমকি দেওয়া, কখনও বিপক্ষ শিবিরের মহিলা প্রার্থীকে ছাপার অযোগ্য ভাষায় সম্বোধন করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
তবু অনুব্রত মণ্ডলকে আপাতত ভর্ৎসনা করেই রেহাই দিল নির্বাচন কমিশন!
গত মাসে বোলপুরে দলীয় কর্মিসভায় মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য ‘কেষ্ট’ বলেছিলেন, ‘‘যদি দেখেন পাঁচ-সাতটা বাড়ি (আমাদের) ভোট দেবে না, তা হলে তাদের ভোট দেওয়ার দরকার নেই।’’ তার পরে ময়ূরেশ্বরের বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের উদ্দেশে কুকথা বলেন তিনি। দু’টি ঘটনাতেই অভিযোগ দায়ের হয়েছিল নির্বাচন কমিশনে। প্রথম ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন আগেই শো-কজ করেছিল অনুব্রতকে। তৃণমূল নেতার জবাবে সন্তুষ্ট হয়নি কমিশন।
সূত্রের বক্তব্য, এর মধ্যে ঠিক কোন ঘটনাটিতে অনুব্রতকে ভর্ৎসনা করা হচ্ছে, এ দিন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের পাঠানো চিঠিতে তা স্পষ্ট নয়। তবে অনেকের মতে, ভোটারদের হুমকির অভিযোগ নিয়ে অনুব্রতর ব্যাখ্যায় যে হেতু কমিশন ইতিমধ্যেই অসন্তোষ জানিয়েছে, তাই হতে পারে, ওই ঘটনাটিতেই তাঁকে ভর্ৎসনা করার জন্য রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছে তারা।
বিরোধীরা অবশ্য এই নির্দেশে খুশি নন। তাঁদের মতে, তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত যে ভাবে নিয়মিত প্রকাশ্য সভা থেকে বিরোধীদের হুমকি দিয়ে থাকেন, যে ভাবে শালীনতার গণ্ডি টপকে যান, তাতে তাঁকে শুধু ভর্ৎসনা করে ছেড়ে দেওয়াটা কার্যত প্রহসন হয়ে দাঁড়াল।
এই ‘ভর্ৎসনা’র অর্থ কী?
কমিশনের আধিকারিকেরা বলছেন, ভর্ৎসনা কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়। সতর্কীকরণের একটি ভারী শব্দমাত্র। এর ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপরে কোনও বিধিনিষেধ আরোপিত হয় না। পরবর্তী সময়ে এই ধরনের কথা বলা থেকেও তাঁকে বিরত করা যায় না। এটি কোনও চূড়ান্ত সতর্কবার্তাও নয়। আর অনুব্রত বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হননি বলে তাঁর ভোটে লড়ার উপরেও কোনও বিধিনিষেধ আরোপেরও সুযোগ নেই। শুধু ভবিষ্যতে একই ধরনের মন্তব্য করলে তাঁকে আবার ভর্ৎসনা করা যেতে পারে।
অনেকে অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কমিশন যদি মনে করে কারও মন্তব্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে, তবে সেই ব্যক্তিকে গ্রেফতারের নির্দেশও দিতে পারে তারা। কিন্তু দেখা যায়, অনুব্রত বারবার রেহাই পেয়ে যান। কমিশন অতীতে বড় জোর তাঁকে সতর্ক করেছে। আর রাজ্য প্রশাসনের কথা না বলাই ভাল। ‘ওর মাথায় অক্সিজেন কম যায়’ বলে প্রকাশ্যেই অনুব্রতর পাশে দাঁড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে পুলিশ তাঁকে ছোঁয়নি। গত পাঁচ বছরে কার্যত অকুতোভয় হয়ে উঠেছেন এই নেতা।
এর পর নারদ-টেপেও (যার সত্যতা যাচাই করা আনন্দবাজারের পক্ষে সম্ভব হয়নি) পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে বলতে শোনা গিয়েছে, ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগের রাতে সিপিএমের এজেন্টদের ঘরে ঢুকিয়ে ‘সিল’ করে দিয়েছিলেন অনুব্রতরা। অনুব্রত নিজেও ‘গুড়-জল’ দিয়ে ভোট করানোর কথা খোলাখুলিই বলে থাকেন। এমনকী মঙ্গলবারও বিরোধীদের ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
বিরোধীদের মতে, অভিযোগটা যে-হেতু নির্বাচনী আচরণবিধির ভঙ্গের এবং রাজ্য প্রশাসন যে-হেতু এখন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের অধীন— তাই তাঁরা কিছুটা আশা দেখেছিলেন। কিন্তু এই ভর্ৎসনা আদপে পর্বতের মূষিক প্রসব হয়েই দাঁড়াল। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘অনুব্রত মণ্ডল-সহ তৃণমূলের অনেক নেতাই অপরাধীদের ভাষায় কথা বলছেন। নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ করছেন। অবাধ নির্বাচনের স্বার্থেই গ্রেফতার করা উচিত অনুব্রতকে। শুধু সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়।’’ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘উনি যা যা বলেছেন তাতে ওঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করে ফৌজদারি মামলা শুরু করা উচিত ছিল। স্রেফ ভর্ৎসনা করায় নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতাই প্রকট হল।’’