জয়ন্তকুমার নন্দী
রাতেই নাকি তেনারা আসেন। মালিয়াড়াতেও এসেছিলেন। রবিবার।
বড়জোড়া বিধানসভা কেন্দ্রের মালিয়াড়ায় পরীক্ষাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছয় ও সাত নম্বর বুথে গভীর রাতে ‘ভূত’ এল। সংখ্যায় প্রায় জনা ১৭-২০।
তখন ভোটযন্ত্র পরীক্ষা করছিলেন ভোটকর্মীরা। হঠাৎই তেনারা বুথে চড়াও হয়ে ‘সিপিএমের হয়ে ভোট দিচ্ছিস?’ বলে প্রিসাইডিং অফিসার-সহ দুই ভোটকর্মীকে বেধড়ক মারধর করে ইভিএম মেশিন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালালেন। মোবাইলও কেড়ে নিলেন। চেষ্টা করলেন তখনই বোতাম টিপে নির্দিষ্ট একটি চিহ্নে ভোট দিয়ে রাখতে। যাওয়ার আগে শাসানি দিয়ে গেলেন, ভোটের সময় ছাপ্পা চলাকালীন চোখ-কান যেন বন্ধ থাকে!
দিনের শেষে পুলিশ-প্রশাসনের চোখে সেই ‘ভূতেরা’ অবশ্য অদৃশ্য থেকে গিয়েছে। গুরুতর আহত, আতঙ্কিত প্রিসাইডিং অফিসার জয়ন্তকুমার নন্দী এবং পোলিং অফিসার প্রণবকুমার মণ্ডল, মিলনকুমার মণ্ডল ও লক্ষ্মীকান্ত মাহাতো-রা সোমবার অভিযোগ করেছেন, ঘণ্টাখানেক এই তাণ্ডব চলার সময় বুথের দোতলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ঘুমোচ্ছিল। প্রায় ৪০ মিনিট পরে বারমুডা আর গেঞ্জি পরে এক জন জওয়ান নীচে নেমে সব দেখেই দ্রুত উপরে উঠে যান। মিলনবাবু ও লক্ষ্মীকান্তবাবু কোনও রকমে ছুটে পালান। পুলিশ যখন এসেছে, ততক্ষণে মারের চোটে অন্য দুই ভোটকর্মী প্রায় অজ্ঞান।
রবিবারই আনন্দবাজার লিখেছিল, ভোটের আগের রাতে বাঁকুড়ার বিভিন্ন এলাকায় ভূতের নৃত্যের আশঙ্কা করছেন বিরোধীরা। তা যে ভুল নয়, তারই হাতে-গরম প্রমাণ মালিয়াড়ায় মিলল বলে দাবি বিরোধীদের।
আহতদের অভিযোগ, রাতেই বড়জোড়ার বিডিও পঙ্কজ আচার্যকে সব জানিয়ে তাঁদের অবিলম্বে রিলিজ করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সারা রাত বিনা চিকিৎসায় তাঁদের বুথেই ফেলে রাখা হয়। বাঁকুড়ার মায়াকানন হাইস্কুলে ভূগোলের শিক্ষক জয়ন্তবাবুর কথায়, ‘‘মালিয়াড়া ফাঁড়ি বলে দিল, এফআইআর নেওয়া যাবে না। বড়জোড়া থানার আইসি-কে বললাম, এফআইআর করতে চাই। উনি বললেন, ‘কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছেন? একটা সাদা কাগজে কী হয়েছে লিখে দিন। পরে দেখে নেব’।’’
এ দিন সকালে অন্য এক জনের ফোন থেকে জয়ন্তবাবু বাঁকুড়া শহরে স্ত্রী সীমা নন্দীকে সব বলেন। সীমাদেবী ছুটে যান অতিরিক্ত জেলাশাসক পার্থ ঘোষের কাছে। সীমাদেবীর কথায়, ‘‘বললাম, এখনই ডিএম-কে বলুন ওঁকে রিলিজ দিতে। না হলে আপনার ঘরের সামনেই বসে থাকব। উনি ডিএম-কে ফোন করে এক ঘণ্টার মধ্যে ওঁদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেন।’’ জয়ন্তবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁদের বদলি হিসাবে চার জনকে পাঠানো সত্ত্বেও তাঁরা রিলিজ পেয়েছেন এ দিন বেলা একটা-দেড়টা নাগাদ। ভীত-সন্ত্রস্ত দম্পতির প্রশ্ন, ‘‘ভোটের নামে কী হচ্ছে এই সব? কাদের ভরসায় ডিউটি করতে যাব?’’
একই প্রশ্ন উঠেছিল লোকসভা ভোটে। এই বাঁকুড়ারই সোনামুখীতে। দলবল নিয়ে বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর ও দেদার ছাপ্পা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার বিরুদ্ধে। সেই অফিসারও প্রশ্ন তুলেছিলেন, এর পর কোন সাহসে কেউ ভোটের ডিউটি করতে যাবেন?
এ দিন দুপুরে ওই বুথে গিয়ে দেখা গেল, সামনে সাত-আট জন সিআরপি জওয়ান। কাল রাতে কী হয়েছিল? এক জওয়ানের উত্তর, ‘‘কুছ নেহি হুয়া। সব পিসফুল হ্যায়!’’ তখনই গাড়ি থেকে নামলেন তৃণমূল প্রার্থী সোহম চক্রবর্তীর নির্বাচনী এজেন্ট সুখেন বিদ। রাতের কথা তুলতেই দাবি করলেন, ‘‘প্রিসাইডিং অফিসার ইভিএম পরীক্ষা করছিলেন। সেই শব্দে কিছু লোক ভেবেছিল ভোট পড়ছে। কোনও মারধর হয়নি তো!’’ সংবাদমাধ্যমের মুখে ঘটনাটা শুনে অবাক মুখে সোহম তাঁর এজেন্টের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আমাকে তো এ সব কিছু জানাওনি!’’ বড়জোড়ার আইসি দিলীপ কর্মকার আবার দাবি করলেন, ‘‘গাজন নিয়ে সামান্য সমস্যা হয়েছিল। লিখিত অভিযোগ হয়নি।’’ বিডিও-র বক্তব্য, ‘‘কিছু বলতে পারব না, মাফ করবেন।’’ অতিরিক্ত জেলাশাসকেরও একই কথা।
বড়জোড়ার সিপিএম প্রার্থী সুজিত চক্রবর্তী বা দলের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরী শুধু বললেন, ‘‘লুম্পেন ঢুকিয়ে তৃণমূল ইভিএম লুঠ করতে চেয়েছিল। ভোটকর্মীদের পিটিয়েছে, যাতে ওঁরা ছাপ্পা দেখলেও মুখ বুজে থাকেন। প্রশাসনের কর্তাদের ঘাড়ে ক’টা মাথা যে, তৃণমূলের গুণ্ডাদের কিছু বলে?’’