প্রায় দু’ মাস ধরে প্রচার যুদ্ধ চালানোর পর রাজ্যের মানুষ তাঁদের রায় জানান দিয়েছেন। গণদেবতার সেই রায় আপাতত স্ট্রং রুমে বাক্সবন্দি। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ১৬ টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটের ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিকভাবে যুযুধান বিভিন্ন প্রার্থী ও দলীয় নেতাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ পর্বের শেষ হওয়ার পর থেকেই।
রাজ্যে এ বার বিধানসভা নির্বাচনের আগে শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দীর্ঘদিনের সংঘাত সরিয়ে বাম-কংগ্রেস জোট বাঁধা যেমন ভোটের সমীকরণ বদল হওয়ার আভাস দিয়েছিল তেমনই ভোট প্রক্রিয়া শুরুর কিছুদিন পরেই নারদ-স্টিং কাণ্ডে তৃণমূলের একাধিক নেতার ঘুষ নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসায় ভোটের প্রচারে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র চলে আসে। ফলে বিধানসভা ভোটের প্রচারে শাসক–বিরোধীদের প্রচারের লড়াই তুঙ্গে ওঠে।
তবে প্রথম কয়েক দফা ভোটে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকায় শাসক দল ভোট নিয়ন্ত্রণের কিছুটা সুযোগ পেলেও বিরোধীদের লাগাতার নালিশের জেরে ছবিটা ক্রমশ বদলাতে থাকে। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতার জেরে সাধারণ মানুষ হুমকি অগ্রাহ্য করে তাঁদের রায় দিতে পেরেছেন বলে স্বীকার করেছে বিরোধীরাও। শেষ দফার ভোট প্রচারে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় এসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি হুশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকার জেরে গত বৃহস্পতিবার জেলা জুড়েই মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছে।
নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের আবহে গত ২০১১ সালে জেলার ১৬ টি আসনেই জিতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য লাভ করে তৃণমূল। কিন্তু পাঁচ বছর পর তৃণমূলের সেই গড় অটুট আছে কি না তা নিয়ে আগ্রহ কম নয়। শাসক দলের অন্যতম কাণ্ডারি শুভেন্দু অধিকারী এ বার নিজে নন্দীগ্রাম বিধানসভায় প্রার্থী হয়েছেন। ফলে জেলার ১৬ টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের জয় পরাজয়ের সাথে শুভেন্দুর জেতার মার্জিন নিয়ে নানা জল্পনা চলছে। নিজের জয় ছাড়াও দলনেত্রীর সামনেই জেলার ১৬ টি আসন জিতবেন বলে দাবি করেছিলেন শুভেন্দু। অন্য দিকে বিরোধী শিবিরের নেতা সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র জেলায় প্রচারে এসে বলেছিলেন শেষ দফার ভোটে দফারফা হবে তৃণমূলের।
শেষ দফার ভোটেও পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে নালিশ করেছেন তৃণমূলের নেতারা। আর উল্টো সুর বিরোধীদের গলায়। তবে এবার কি জেলার সব আসনে জেতা নিয়ে কোনও আশঙ্কা রয়েছে?
এ বার বিধানসভা ভোটে জেলার ১৬ টি আসনের মধ্যে নন্দীগ্রাম, খেজুরি, দক্ষিণ কাঁথি, পটাশপুর, ভগবানপুর, ময়না, চণ্ডীপুর, মহিষাদল আসন শাসক দলের জেতা প্রায় নিশ্চিত। আর এগরা, হলদিয়া, উত্তর কাঁথি, রামনগর, তমলুক, পূর্ব পাঁশকুড়া, পশ্চিম পাঁশকুড়া, নন্দকুমার আসনে শাসক ও বিরোধীদের জোরদার লড়াই হয়েছে। এর মধ্যে এগরা, পূর্ব পাঁশকুড়া, উত্তর কাঁথি ও হলদিয়া আসনে বিরোধীদের জেতার সম্ভবনা রয়েছে।
ভোটগ্রহণ পর্ব শেষের পর পূর্ব পাঁশকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী বিপ্লব রায়চৌধুরী অবশ্য বলেন, ‘‘জেতা নিয়ে আমার কোন সংশয় নেই। আগের বারের চেয়ে ব্যবধান কিছুটা কমলেও জয়ের বিষয়ে আমি নিশ্চিত।’’ বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম প্রার্থী ইব্রাহিম আলি বলেন, ‘‘মানুষ যেভাব নানা বাধা কাটিয়ে ভোট দিয়েছে তাতে রায় আমাদের অনুকূলে যাবে এটা আমি নিশ্চিত।’’ আর এগরা বিধানসভা কেন্দ্রের বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী মামুদ হোসেন বলেন, ‘‘মানুষ যেভাবে ভয় ভীতি উপেক্ষা করেছে তা শাসক দলের বিরুদ্ধেই যাবে। তাই আমার জয়ের বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।’’
তবে শাসক দলের নেতাদের একাংশের মতে, জেলার তমলুক, নন্দকুমার, পশ্চিম পাঁশকুড়া, পূর্ব পাঁশকুড়া, রামনগর প্রভৃতি কেন্দ্রে আসনে বিরোধীদের জোরদার লড়াই হলেও জয় হবে। বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ পর্বে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকায় বাড়াবাড়ির অভিযোগ তুললেও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল সভাপতি শিশির অধিকারী বলেন, ‘‘জেলায় ভাল ভোট হয়েছে। মানুষ আমাদের পক্ষেই রায় দিয়েছে। এবারও জেলায় আমরা ১৬ টি আসনেই জিতব। বিরোধীরা কোন আসনেই জিততে পারবে না।’’
বাম-কংগ্রেস জোটের ফল নিয়ে সিপিএম জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহির দাবি, ‘‘তৃণমূলের লোকজন হুমকি দিয়ে আমাদের পোলিং এজেন্টদের বসতে বাধা দিলেও হুমকি উপেক্ষা করে মানুষ ভোট দিয়েছেন। জেলার ১৬ টি বিধানসভা আসনের মধ্যে কমপক্ষে ৬ টিতে আমাদের প্রার্থীরা জয়ী হবে।’’ দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, হলদিয়া, এগরা, পূর্ব পাঁশকুড়া, পশ্চিম পাঁশকুড়া, উত্তর কাঁথি ও তমলুক আসনে জেতার বিষয়ে আশাবাদী বাম-কংগ্রেস জোট নেতৃত্ব। তবে শেষপর্যন্ত তৃণমূলের গড় অটুট থাকে কিনা তা জানার জন্য আগামী ১৯ মে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।