সলতেটা পাকিয়েছিলেন প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি। সর্বভারতীয় সভাপতি তাতে আগুন দিলেন।
শাসক দলই ঘুষের ফাঁদ পেতে দুই পুলিশ কর্মীকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিল বলে সোমবার অভিযোগ করেছিলেন রাহুল সিংহ। পুলিশ কমিশনার এই চক্রান্তে জড়িত বলেও তিনি দাবি করেছিলেন ঘনিষ্ঠ মহলে। মঙ্গলবার কলকাতা প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক সম্মেলনে সেই অভিযোগ আরও উঁচু তারে বেঁধে দিলেন অমিত শাহ। বললেন, ‘‘রাজ্য সরকার চর-পুলিশ পাঠিয়েছিল। আমাদের নেতা রাহুল সিংহকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল। দু’জন সেপাইকে ধরে কী হবে? পুলিশ কমিশনারের হাত আছে। তাঁর নির্দেশেই এ সব হয়েছে।’’ এর পরেই নির্বাচন কমিশনের কাছে পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানায় বিজেপি।
বিজেপি-র কেন্দ্রীয় দল দিল্লিতে এ দিন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদীর সঙ্গে দেখা করে। সেখানেই রাজীব কুমারের অপসারণের দাবি জানায় তারা। কলকাতাতেও রাজ্যের প্রতিনিধিদল মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্তর কাছে একই দরবার করে। জৈদীর কাছে বিজেপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, রাজীবের মতো কিছু পুলিশকর্তা ও আমলা কার্যত তৃণমূলের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তাঁদের দায়িত্ব থেকে না সরালে স্বচ্ছ ও অবাধ ভোট হবে না। পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি জানান, যথোচিত পদক্ষেপ করা হবে বলে জৈদী তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন। আর কলকাতায় রাহুল তোপ দেগে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ রাজীব কুমার সারদা-কাণ্ডের বহু তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছেন। তাঁকে পুলিশ কমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব নয়।’’
বিজেপি নেতাদের এ হেন অভিযোগ অবশ্য ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে লালবাজার। অমিতের অভিযোগ নিয়ে পুলিশ কমিশনারের (সিপি) বক্তব্য জানতে চাইলে তাঁর দফতর থেকে জানানো হয়, এ ব্যাপারে যা বলার যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলবেন। সুপ্রতিম বলেন, ‘‘অভিযোগ ভিত্তিহীন।’’ লালবাজারের একটি সূত্র জানাচ্ছে, শুভাশিস রায়চৌধুরী ও আমিনুর রহমান নামে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুই কর্মী ধরা পড়ার পরে ঘনিষ্ঠ মহলে যথেষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিপি। এই ঘটনা যে তাঁকে বিপাকে ফেলবে, তা আঁচ করেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
তবে এই ঘুষ-কাণ্ড যে কী ভাবে পুলিশকর্মীদের উপরে চেপে বসেছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে লালবাজারের এক কর্তার কথায়। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘বাজারে গিয়েছিলাম। সবার এত প্রশ্ন যে বিরক্ত হয়ে বাজার না করেই চলে এসেছি।’’ অন্য এক অফিসারের কথায়, ‘‘শাসক দলকে সুবিধা পাইয়ে দিতে পুলিশ এ কাজ করেছে কি না, বলতে পারব না। কিন্তু এই আমলে পুলিশের মেরুদণ্ড সোজা রয়েছে, এ কথাও কি বুক ঠুকে বলতে পারছি?’’ কলকাতা পুলিশের শীর্ষকর্তারা মুখে অমিতের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বললেও সোমবার রাত থেকেই লালবাজারের অন্দরে কানাঘুষো চলছে। উপরমহলের নির্দেশ ছাড়া দুই পুলিশ কর্মী কী ভাবে রাহুলের কাছে ঘুষের টোপ ফেলতে গেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে পুলিশের অন্দরেই। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘বিজেপি-র অভিযোগ বাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সেই প্রশ্নের দ্রুত জবাব মেলা জরুরি।’’
সোমবার দুপুরে ওই ঘটনার পরেপরেই অবশ্য নবান্নে গিয়ে প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের কাছে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন রাজীব। তাঁর তরফে জানানো হয়েছিল, বিজেপি কলকাতা পুলিশে সংগঠন করতে চেষ্টা করছিল। বলা হয়েছিল, সীমান্তে পোস্টিং করিয়ে দেওয়া হবে। সে সবকারণে এমন কাণ্ড কেউ করে থাকতে পারে। তখনই এই ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পুলিশের একাংশ। তাঁরা বলেন, কলকাতা পুলিশের কর্মীদের রাজ্য পুলিশের সীমান্ত এলাকায় কী ভাবে পোস্টিং করিয়ে দেবে বিজেপি? সন্ধের আগেই সিপি-র বয়ান বদলে যায়। তখন বলা হয়, নিছকই ব্যক্তিগত কারণে ওই দুই পুলিশকর্মী রাহুল সিংহের কাছে গিয়েছিলেন। কলকাতা পুলিশের সূত্র জানাচ্ছে, এ দিন নবান্নেও ঘুষ-কাণ্ডের যে প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে তাতে দুই পুলিশকর্মীকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতেই তাঁরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে বাহিনীর যোগ নেই। একই সঙ্গে অভিযুক্তদের কাজে অপরাধমূলক প্রবণতা পাওয়া যায়নি বলে এফআইআর-ও দায়ের হয়নি।
লালবাজার অবশ্য ঘুষ-কাণ্ডে দু’টি পৃথক তদন্ত শুরু করেছে। একটির দায়িত্বে স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, অন্যটির দায়িত্বে ডিসি ( সেন্ট্রাল) অখিলেশ চতুর্বেদী। ঘুষ-কাণ্ডে গরু পাচারের প্রসঙ্গ সামনে আসায় এসটিএফের একটি দলকে মুর্শিদাবাদেএ পাঠানো হয়েছে। এ দিনও ধৃত দুই পুলিশকর্মীকে ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদ করেন ডিসি। সেখান থেকে বেরনোর সময় আমিনুর বলেন, ‘‘বিভাগীয় তদন্ত চলছে। পরে সব জানতে পারবেন।’’ কিন্তু কে তাঁকে রাহুলের কাছে পাঠিয়েছিল, তার উত্তর দেননি আমিনুর। ডিসি অফিস থেকে তাঁরা যান লর্ড সিনহা রোডের এসবি অফিসে। সেখানে আর এক প্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ চলে।
এ দিনই প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেন, ‘‘বিজেপি নেতারা এখন অনেক কথা বলছেন। কিন্তু নারদ নিয়ে কেন্দ্রের তদন্ত করতে অসুবিধা কোথায় ছিল? মানুষ যখন নারদ নিয়ে জানতে চাইছেন, তখন নজর ঘোরাতে আর একটা ঘটনা সামনে এনে ফেলা হয়েছে।’’ এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বিজেপি নেতারা বলছেন, নারদ প্রকাশ্যে আসার পর একই কৌশলে বিজেপি নেতৃত্বকে ফাঁসানোর চেষ্টা হয়েছিল। নারদের স্টিং অপারেশনে যে সব তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের প্রার্থীপদ বাতিল করার দাবি জানিয়েছে বিজেপি। তাঁদের বক্তব্য, অভিযুক্ত নেতারা যাতে ভোটের প্রচারে অংশ নিতে না পারেন, সেই পদক্ষেপও করুক কমিশন।