গুড়-জলের ওষুধ হাতে ওত পেতে কেষ্ট বাহিনী

ভরা বৈশাখেও লাঙলহাটা বিলে গলা জল। বিকেলের মরা আলোয়, বিলের ওপারে সোনাঝুরির জঙ্গলটা দেখিয়ে আইনুল শেখ বলছেন, ‘‘ওই গাছগাছালির আড়াল দিয়ে বিলের কোল বরাবর খানিক হাঁটলেই আমাদের সুন্দরপুর গ্রাম। আলো পড়ে এলেই ওই পথে লোক ঢুকছে দাদা।’’

Advertisement

কৌশিক সাহা ও অর্ঘ্য ঘোষ

বড়ঞা ও লাভপুর শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০২
Share:

ভরা বৈশাখেও লাঙলহাটা বিলে গলা জল। বিকেলের মরা আলোয়, বিলের ওপারে সোনাঝুরির জঙ্গলটা দেখিয়ে আইনুল শেখ বলছেন, ‘‘ওই গাছগাছালির আড়াল দিয়ে বিলের কোল বরাবর খানিক হাঁটলেই আমাদের সুন্দরপুর গ্রাম। আলো পড়ে এলেই ওই পথে লোক ঢুকছে দাদা।’’

Advertisement

গামছা মোড়া মুখ, কারও হাতে লাঠি, কারও বা পিঠে ঝুলছে ব্যাগ। হাতে লাঠি কেন, পিঠের ব্যাগেই বা রয়েছে কী? প্রশ্নটা করেছিলেন মুর্শিদাবাদের মান্দ্রা গ্রামের কানাই মণ্ডল। আমতা আমতা করে বলছেন— ‘‘লোকটা ঠাস করে চড় মেরে বললে, ‘তোর বাপের কী?’’

তেনারা এসে পড়েছেন!

Advertisement

বীরভূমের ভোট পর্ব মিটতেই অনুব্রত মণ্ডলের ‘দশানন’ যে পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদে ‘ভোট করাতে’ নামবে— দিন কয়েক ধরেই অভিযোগ করছিলেন কান্দি, বড়ঞা কিংবা ভরতপুরের কংগ্রেস নেতারা। জোট শিবির থেকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছিল নির্বাচন কমিশনকেও। বুধবার বিকেলে সুন্দরপুর গ্রামে পা দিয়েই বোঝা গিয়েছে, সে অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বুধবার বিকেলেই
ওই এলাকায় গিয়েছিলেন বড়ঞার সেক্টর অফিসার।

ময়ূরাক্ষীর কোল বরাবর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সুন্দরপুর, মান্দ্রা, লাঘষা— মুর্শিদাবাদের ছোট ছোট জনপদ। এক দিকে বর্ধমানের কেতুগ্রাম আর কয়েক কিলোমিটার দূরে বীরভূমের, লাভপুর-নানুরের মাঠ। সে পথে যে তাঁর ‘বাহিনী’ মুর্শিদাবাদে আসবে, সোমবার তা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন তৃণমূলের ‘কেষ্ট’দা। নির্বাচন কমিশনের চব্বিশ ঘণ্টার নজরদারির বেড়ি এড়িয়ে এর মধ্যেই তিনি বড়ঞার কাছেই সালারে এসে পথসভাও করে গিয়েছিলেন। খোলা গলায় শাসিয়ে গিয়েছিলেন, ‘‘মুর্শিদাবাদের দাদা এখানে চমকাতে এলে মনে রাখবেন আমরাও পাল্টা চমকাতে পারি। প্রয়োজনে আমি নিজে বীরভূম থেকে আসব।’’ সুন্দরপুর এবং তার আশপাশের গ্রামগুলিতে ওই অচেনা মুখের ভিড় সেই অনুব্রত ‘বাহিনীর লোক’ বলেই আশঙ্কা করছেন বড়ঞার কংগ্রেস প্রার্থী প্রতিমা রজক। বলছেন, ‘‘বীরভূমের মতোই এখানেও আতঙ্ক ছড়াতে চাইছেন অনুব্রত।’’ সেই ভয় ছড়িয়েছে বীরভূম লাগোয়া মুর্শিদাবাদের ভরতপুর এবং সালার এলাকাতেও।

লাঙলহাটা বিলের গা ঘেঁষেই বীরভূমের দাঁড়কা পঞ্চায়েত। একদা সেখানেই উপপ্রধান ছিলেন অনুব্রতর অন্যতম অস্ত্র মনিরুল ইসলাম। তৃণমূলের অন্দরের খবর, লাভপুরের কাজিপাড়া, ঠিবে কিংবা বাগতোড় গ্রাম থেকে ইতিমধ্যেই ‘বাহিনী’ পাঠানো হয়েছে মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর, বৈদ্যনাথপুর, কয়ঠা কিংবা মজলিশপুরে। ঘাঁটি গেড়ে সেখানেই রয়েছেন
সেই ‘ভোটকর্মী’রা। প্রয়োজনে তারাই বৃহস্পতিবার বড়ঞার বিভিন্ন গ্রামে ‘ঢাক’ বাজাবে বলে আশঙ্কা করছেন জোটের নেতারা।

মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের এক কর্তাও বলছেন, ‘‘বীরভূম থেকে গুড়জল খাওয়ানোর লোক যে আসছে সে খবর মিলেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ঠিক কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনও নির্দেশ কিন্তু উপর থেকে আসেনি।’’

বীরভূম জেলা তৃণমূলের এক নেতা জানাচ্ছেন, লাভপুর থেকে দলের প্রায় শ’খানেক ‘লড়াকু’ কর্মীকে পাঠানো হয়েছে বাহাদুরপূরের দু’টি বিয়ে বাড়িতে। ওই নেতার গলায় মস্করার সুর, ‘‘আরে বাবা ওরা তো বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রিত, ওদের ঠেকাবে কে? তবে, ওখানে তারা মাথা গরম করে ফেলবে কি না জানি না!’’

সুন্দরপুর একা নয়, তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে দলের বহিরাগত কর্মীরা দাপিয়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেছেন কান্দির কংগ্রেস প্রার্থী
অপূর্ব সরকার। কান্দি ব্লক কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘‘কান্দির
তৃণমূলের প্রার্থীর সঙ্গে তো সব সময়েই দেখছি জনা তিরিশ যুবক। তাদের পোশাক, চাল চলন, কথাবার্তায় স্পষ্ট— বাইরে থেকে এসেছেন তারা।’’ যা শুনে তৃণমূলের এক জেলা নেতা রীতিমতো তেড়ে উঠছেন— ‘‘ভোটের সময়ে কেউ কোথাও যেতে পারবে না নাকি! যাঁরা এসেছেন, তাঁরা দলের কর্মী, কলকাতার রাজারহাট থেকে এসেছেন। দোষের কী আছে?’’

দলের অন্দরের খবর, বহিরাগত ওই যুবকেরা রয়েছেন কান্দি বাইপাস লাগোয়া যশোহরি-আনখোলা এলাকায়। তবে কান্দির তৃণমূল
প্রার্থী শান্তনু সেন অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, ‘‘বহিরাগতদের এনে ভোট করানোর গল্পটা জোটের নেতাদের বানানো। আমি তো দেখছি উল্টো চিত্র, স্থানীয় কংগ্রেস প্রার্থীর ভাই তাঁর দাদার জন্য নিরন্তর টাকা ছড়াচ্ছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement