মিনি ভারতের মাটি ছুঁয়ে ধারাবাহিক চাচা কাহিনি

একটু ছানার সঙ্গে ১০ টাকার নোনতা সুজি এনে দিয়েছিলেন জনৈক সহচর। এক কাপ কফিযোগে বড়জোর অর্ধেকটা টুকটুক করে খেলেন তিনি। তখন মোটামুটি বেলা ন’টা-সওয়া ন’টা। বেলা দু’টো অবধি আর কিছু দাঁতেই কাটবেন না তিনি।

Advertisement

ঋজু বসু

খড়্গপুর শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৯
Share:

খড়্গপুরে দলের কার্যালয়ে জ্ঞান সিংহ সোহনপাল। ছবি: কিংশুক আইচ।

একটু ছানার সঙ্গে ১০ টাকার নোনতা সুজি এনে দিয়েছিলেন জনৈক সহচর। এক কাপ কফিযোগে বড়জোর অর্ধেকটা টুকটুক করে খেলেন তিনি।

Advertisement

তখন মোটামুটি বেলা ন’টা-সওয়া ন’টা। বেলা দু’টো অবধি আর কিছু দাঁতেই কাটবেন না তিনি। মাঝে এক বার সামান্য দুধ চা, অল্প চিনি দিয়ে। ব্যস! ‘লাঞ্চ’ সারবেন স্রেফ গোটা দুয়েক কালাকাঁদে। কোনওদিন অল্প রায়তা আর আধখানা রুটি। শরীরে এটুকু ‘তেল’ ভরেই সজাগ, সচল, ছিপছিপে সর্দার।

চল্লিশ ডিগ্রি গরমে দেড় ঘণ্টার রোড শোয়ে খোলা জিপে ঠায় দাঁড়িয়ে খড়্গপুরের ‘চাচা’। সে-দিন যাঁর ‘স্ট্যামিনা’ দেখে মুগ্ধ হলেন প্রচারে আসা দক্ষিণী নায়িকা নগমা। দু’ধারে উৎসাহী জনতার ছুড়ে দেওয়া রজনীগন্ধা-গোলাপের মালা গলায় পরে দাঁড়িয়ে স্বভাবসিদ্ধ হাসি ধরে রাখলেন জ্ঞান সিংহ সোহনপাল। এ বছরের গোড়ায় যিনি ৯২ বছরে পা দিয়েছেন।

Advertisement

খড়্গপুরে ভোটযুদ্ধের শরিক সেই ’৬২ সাল থেকে। অজয় মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলের মন্ত্রী। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, কারা, পরিবহণ, পরিষদীয় বিষয়ের মতো দায়িত্ব সামলেছেন। দশ বারের রেকর্ড গড়া বিধায়ক। প্রথম জীবনে নারায়ণ চৌবের কাছে দু’বার হারার পর ’৬৯ সালে তাঁকে হারিয়েই বিধানসভায় পদার্পণ। আর এক বার হেরেছিলেন, ’৭৭ সালে। এর পরে নাগাড়ে জিতে আসছেন। এখনও বিদায়ী বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির তিনি চেয়ারম্যান। যিনি সচরাচর কলকাতায় মিটিং সেরে বিকেল-বিকেল খড়্গপুরে ফেরার পথে কোলাঘাটের ধাবায় সস দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খান একখানি শিঙাড়া।

আর ‘বিলাসিতা’, রাতের বরাদ্দ রসগোল্লা! আমিষে বা পায়েসেও রুচি নেই মোটে। নিতান্তই ‘পাখির আহার’। এটুকু পুঁজি করেই ভোটযুদ্ধে নিজের রেকর্ড ভাঙতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ‘মিনি ইন্ডিয়া’ খড়্গপুরের শিখ সন্তান। একমাত্র দক্ষিণের দুই ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী— তামিলনাডুর এম করুণানিধি ও কেরলের ভি এস অচ্যুতানন্দন ছাড়া এই মুহূর্তে দেশের রাজনীতিতে এমন নাছোড় তারুণ্যের নমুনা কই! করুণানিধি বা ভি এস-এর মতো চাচা অবশ্য ঠিক বলিয়ে-কইয়ে নন। জনসভায় বক্তৃতা দেন না। হয়তো খড়্গপুরে বলার দরকারই পড়ে না ‘চেনা বামুনে’র।

বলতে গেলে, প্রয়াত বরকত গনি খান চৌধুরীর সঙ্গে মালদহ যেমন প্রায় সমার্থক, চাচা আর খড়্গপুরের সম্পর্কও খানিকটা তেমনই। তবে দিল্লির ডাকসাইটে মন্ত্রী বা কংগ্রেসের প্রদেশ নেতা গনির চেয়ে চাচার গোটা ব্যাপারটাই অনেক নিচু তারে বাঁধা। রাজনীতির আকচাআকচিতেও নেই পরিশীলিত সর্দার। বলেন, ‘‘আমি সাধারণ কর্মী। প্রদেশ সভাপতি-টতি হওয়ার আমার ক্যালিবার নেই!’’ বিধায়কের নামে কোনও ফলকও সহজে দেখা যায় না এ তল্লাটে। কিন্তু লোকে বলে, রেলশহরে সরকারি অফিস-হাসপাতাল-জল সরবরাহ— সব কিছুতে জড়িয়ে এই তরতাজা বৃদ্ধের নাম।

যদিও বয়সকেই চাচার প্রধান দুর্বলতা সাব্যস্ত করে খোঁচা দিচ্ছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা। এত বয়সেও জ্ঞান সিংহের বিকল্প খুঁজে পাননি প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, খড়্গপুরের কংগ্রেসি কাউন্সিলরদেরই অনেকে এতে খুশি নন। কারণ, এঁদের কারও কারও আশা ছিল, এ যাত্রা চাচার বদলে টিকিট পাবেন। সেই আশা মিথ্যে হয়েছে। তৃণমূল প্রার্থী তথা স্থানীয় ব্যবসায়ী রমাপ্রসাদ তিওয়ারির দাবি, কংগ্রেসের অনেকেই এখন চাচাকে ছে়ড়ে তাঁর পাশে! বিজেপি প্রার্থী তথা দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও একসুর। গত লোকসভা ভোটে খড়্গপুরে বিজেপিই এগিয়ে ছিল— মনে করিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘বড়জোর বামেদের ভোটটুকুই চাচা পাবেন। এত বয়সে ভোটে দাঁড় করিয়ে খামোখা ওঁর উপরে অত্যাচার হল!’’ এ হেন বৃদ্ধের সঙ্গে পাঙ্গা নিতেই খড়্গপুরে সভা করে গিয়েছেন খোদ নরেন্দ্র মোদী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অনেক ভেবেও চাচাকে ব্যক্তিগত আক্রমণের মশলা খুঁজে পাননি কেউ।

আর চাচা? তিনি এই চর্চাটা দিব্যি উপভোগ করছেন। হেসে বলছেন, ‘‘এক বার ভেবেছিলাম, এ বার থাক! অনেক তো হল। পরে ভাবলাম, এখনও যখন ধকল নিতে পারছি, ক্ষতি কী?’’ শ্রবণশক্তিটা একটু কমজোরি হয়েছে, এই যা। কলকাতার সাংবাদিককে স্বাগত জানিয়ে তাঁর আদরের পিঠচাপড়ানিতে বেশ বোঝা গেল, শীর্ণ অবয়বেও নেহাত দুর্বল তিনি নন।

গত পনেরো বছর ধরে তাঁকে দেখছেন খড়্গপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তারবাবু অনিরুদ্ধ ঘোড়াই। প্রবীণ বিধায়কের বার্ধক্যকে আমল দিতে রাজি নন তিনিও। একটা চোখে সমস্যা থাকলেও দিব্যি কাগজ পড়েন। শীতে সামান্য ঠান্ডা লাগার ধাত আছে। সুগার-প্রেশার কিচ্ছু ছুঁতেই পারেনি চাচাকে। বছর পাঁচ-ছয় আগে প্রস্টেটের শল্যচিকিৎসা হয়েছিল শুধু। আর বিধায়কের সরকারি নিরাপত্তারক্ষী শুভেন্দু দাস মনে করালেন, ক’বছর আগে মোটরবাইকে যেতে যেতে খড়্গপুরেই এক দুর্ঘটনায় কোমরের হাড়ে চোট পেয়েছিলেন। তার আগে গোলবাজার-চত্বর রোজ বার দুয়েক চক্কর মারতেনই।

এখনও স্মৃতিশক্তি টনটনে। ‘‘কোনও কাজ ফেলে রাখেন না। কখন কোন জামাটা লন্ড্রি থেকে আনতে হবে, সেটা উনিই আমায় মনে করান’’— বললেন শুভেন্দু। ঘুম থেকে উঠে গুরু গ্রন্থসাহিবের পুজো, স্নান, চুল বাঁধা, প্রাতরাশ, গুরুদ্বার হয়ে পার্টি অফিসে যাওয়ার রুটিন যেন ছকে বাঁধা। ‘‘শুধু গতিটা একটু ঢিমে এখন। সাড়ে পাঁচটার বদলে সাড়ে সাতটায় ওঠেন’’— বললেন চাচার ভাইপো-বৌ ধরমজিৎ কৌর। অ্যাভিনিউ রোডে রেলের লাল টুকটুকে সাবেক বাংলোয় ভাইপো-বৌ ও দুই নাতির সংসারেই থাকেন অকৃতদার মানুষটি। রেলকর্মী ভাইপো মারা যেতে তাঁর চাকরিটা পেয়েছেন বড় নাতি হরমিত। নাতি বললেন, ‘‘একটা মজার ব্যাপার জানেন, দাদু হলেও আমরাও ওঁকে জন্ম থেকে চাচা বলে ডাকি!’’

সর্বজনীন চাচার আবেদন মালুম হয় গোলবাজারের পার্টি অফিসে ঢুকলেই। বেলা দশটা থেকে রাত দশটা— সাধারণত এটাই তাঁর ঠিকানা। ভোটের মরসুমেও গিজগিজে ভিড়। অমুকের প্রতিবন্ধী-শংসাপত্র, তমুকের ছেলের স্কুলের জন্য বাড়ির ঠিকানার প্রমাণপত্র চাই। গত ভোটে চাচার প্রতিপক্ষ, এখন জোটসঙ্গী সিপিএমের অনিল দাস ওরফে ভীমদা বললেন, ‘‘আমরা কত কী কাগজ চাচার কাছে সই করাতে পাঠিয়েছি, কখনও একটা প্রশ্ন অবধি করেননি। মানুষের ওপর এমনই বিশ্বাস!’’

এই বিশ্বাসটাই যেন বারবার ফেরত পেয়ে চলেছেন চাচা। বলেন, ‘‘এক মুহূর্ত ক্লান্ত লাগে না। মানুষের ভালবাসাই আমার ফিট থাকার ওষুধ।’’ নানা কাজে মেতে থাকা, স্বল্প আহার ও শৃঙ্খলার যাপনে একটা ছক খুঁজে পান বার্ধক্য বিষয়ক গবেষকেরা। জেরন্টলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘৯০ পেরিয়েও তরতাজাদের মধ্যে এমন কয়েকটি লক্ষণ প্রকট।’’

দীর্ঘ কর্মময় রাজনৈতিক জীবনে শুধু একটি শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেবেন না চাচা। সেটা কী?

‘‘রাগ!’’ গালপাট্টায় বাঁধা সাদা দাড়ির ফাঁকে চাচা স্মিত হাসেন, ‘‘ওটাই মানুষের ডিফেক্ট। সব গোলমাল করে দেয়!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement