কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া পাহারায় ভোট চলছে যাদবপুরে। শনিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।
যেন স্বপ্নের মতো!
সকালের প্রথম রোদ্দুর থেকে সন্ধ্যার ফুরফুরে হাওয়া পর্যন্ত বুথে বুথে লাইন দিয়ে ভোট দিচ্ছেন মানুষ। টহল দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। কোথাও বেচাল দেখলেই নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করছেন বিরোধীরা। এবং ১০ মিনিটের মধ্যে বাড়তি বাহিনী হাজির হয়ে তাড়া করছে অনিষ্টকারীদের। একই রকম সক্রিয় রাজ্য পুলিশও। শাসক দলের দাদাগিরি ভাঙতে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যেতে তাদের আর শিরদাঁড়ায় টান পড়ছে না!
ষষ্ঠ পর্বে ফের আজব ভোট দেখল পশ্চিমবঙ্গ! ভোট যেমন হওয়া উচিত, তেমন ভোট! যা পশ্চিমবঙ্গে বিরল ছিল এত দিন। আগের পর্বে বিধাননগর-সহ উত্তর ২৪ পরগনা ও হাওড়ার ভোট থেকেই চাকা ঘোরা শুরু হয়েছিল। সেই বৃত্ত আরও সম্পূর্ণ হওয়ার পথে এগিয়ে গেল শনিবার। খাস কলকাতার চারটি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৩১ এবং হুগলির ১৮টি আসনের কোথাও তেমন রিগিংয়ের অভিযোগ নেই। আগের দিন তা-ও হাওড়া বা উত্তর ২৪ পরগনা থেকে দু-একটা ছাপ্পা ভোট-পর্বের খণ্ডচিত্র পেয়েছিল সংবাদমাধ্যম। এ বার সেটাও নেই! রাতারাতি ভূতেরা উধাও। তেনাদের জায়গা এ বার নিয়েছেন মানুষ!
দিনের শেষে শাসক ও বিরোধী, উভয় শিবিরই এক বাক্যে বলছে মানুষ নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন। কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পুলিশকে কুর্নিশ জানিয়েছে বিরোধীরা। শাসক দল কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকায় প্রত্যাশিত ভাবেই অসন্তুষ্ট। তবু মানুষের নিজের ভোট নিজে দেওয়ার স্বস্তি কেউ অস্বীকার করছে না। গত বছর পুর নির্বাচনে কলকাতা ও শহরতলিতে যে ভাবে দেদার ভোট লুঠ হয়েছিল, তার পরে রিগিংয়ের কথা দলের অন্দরে সগর্ব স্বীকার করতেন তৃণমূল নেতারা। এ বার সেই প্রশ্ন আসছে না। মানুষ ভোট কাকে দিয়েছেন, সে পরের কথা। তবে অন্য বার বোঝাই যেত না বিজয়ীরা মানুষের না ভূতের— কার ভোটে জিতে এল! এ বার অন্তত বলা যাবে, মানুষ নিজের হাতেই নিজের ভাগ্য গড়ে নিচ্ছেন! কোন জল কোথায় গড়াবে, সেটা ঠিক করেছেন তাঁরাই।
ভোটের দিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গড়ে ভোট পড়েছে ৭৮.২৫%। সার্বিক পরিসংখ্যান আসার পরে তা অবশ্য আরও বেড়ে যাবে। রাজনীতিকদের মতে, গড়ে ৮০% ভোটের হারের অনেক তাৎপর্য থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে বিশেষ সংশয় নেই যে, এ বারের ভোট-শতাংশের হিসাবে জলের বদলে আসল ভোটই বেশি। তাই বলা যেতে পারে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকা আদতে তৃণমূলেরই দুর্ভেদ্য ঘাঁটি কি না, তার উত্তর মিলতে পারে এই জল কমের ভোট থেকেই।
ভোটের প্রবণতার এই সার্বিক চিত্র থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবানীপুর কেন্দ্রও আলাদা নয়। কমিশনের হিসাব বলছে, ২০১১ সালে পরিবর্তনের ভোটে দক্ষিণ কলকাতার ওই কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল ৬৩.৭৮%। সেখানে ৬ মাস পরে যে উপনির্বাচন থেকে জয়ী হয়ে মমতা বিধানসভায় এলেন, সে বার ভোট পড়েছিল ৪৪.৭২%। আবার ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে ভোটদানের হার ছিল ৬৫.৬২%। আর এ দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, ভোট পড়েছে ৬৬.২৫%। মনে রাখতে হবে, ২০১৪-র ভোটের শতাংশের মধ্যে খানিকটা জল ছিল। তার পরেও বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায় ভবানীপুর বিধানসভা এলাকা থেকে সামান্য ভোটে এগিয়েছিলেন। সুতরাং, মানুষ নিজের ভোট নিজে দেওয়ার পরে এ বার ভোটের হার যখন বাড়ছে এবং জল কমছে, সেই সময়ে শাসক দলের জন্য আরও বেশি অশনি সঙ্কেত থাকা অস্বাভাবিক নয়। ভোট মিটতেই নানা জায়গায় হামলার অভিযোগ সেই বিপদ সঙ্কেতেরই ইঙ্গিত বলে বিরোধীদের মত।
নিজের ভোট নিজে দেওয়ার স্লোগানে অভাবনীয় সাড়া মেলায় বিরোধীরা স্বভাবতই খুশি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে বিরাট সংখ্যায় ভোট দিতে যাওয়ার জন্য মানুষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। হতাশ হয়ে তৃণমূল যে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস শুরু করেছে, মানুষ সেটাও প্রতিরোধ করবেন।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও প্রতিক্রিয়া, ‘‘মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা অপশাসন থেকে মুক্তি চান। বুথে বুথে তাঁরা লাইন দিয়ে ভোট দিচ্ছেন।’’ সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিমও কেন্দ্রীয় বাহিনী, পুলিশ ও কমিশনকে ‘সেলাম’ জানিয়ে বলেছেন, ‘‘ভবানীপুরেও দিদির হুমকি কাজ করেনি। মানুষ ভোট দিয়েছে। দিদিকে আর গঙ্গা পেরিয়ে নবান্নে যেতে হবে না!’’ সেলিমের আরও দাবি, শাসক দলের দাদাগিরির দাপটে নিচু তলার পুলিশকর্মীরা ক্ষুব্ধ। এই ভোটে সুযোগ পেলেই তাঁরা তাই নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছেন। তাতে মানুষও ভরসা পাচ্ছেন।
শাসক দল অবশ্য মনে করছে মানুষের বিপুল হারে ভোট দেওয়া তাদের পক্ষেই আস্থাজ্ঞাপন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় যেমন দাবি করছেন, তাঁরা এই ভোটে ‘অভাবনীয় সাফল্য’ পাচ্ছেন! তাঁর কথায়, ‘‘আগের দফার ভোটেই আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছি। ষষ্ঠ পর্বে এ দিনের ভোটে আমরা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছি।’’ কেন্দ্রীয় বাহিনীর সক্রিয়তাকে তিনি ‘অত্যাচার’ বলে অভিযোগ করেছেন ঠিকই। তা সত্ত্বেও দলে দলে ভোট দেওয়ার জন্য তিনি বাংলার মানুষ ও দলের কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
স্বপ্নের মতো ভোট। দিনের শেষে মানুষের ভোট স্বপ্ন দেখাচ্ছে দু’পক্ষকেই!