জোট কেবল পাটিগণিত নয়, রসায়নও

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়েছে। এই জোটগঠনের ঔচিত্য, প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা নিয়েই এখন রাজ্য-রাজনীতি সরগরম। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের জোট সম্পূর্ণ অভিনব নতুন ঘটনা— আজ পর্যন্ত রাজ্য-রাজনীতি এমন বস্তু দেখেনি।

Advertisement

অসীম চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৩৩
Share:

ছবি: সাধন বিশ্বাস

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়েছে। এই জোটগঠনের ঔচিত্য, প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা নিয়েই এখন রাজ্য-রাজনীতি সরগরম। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের জোট সম্পূর্ণ অভিনব নতুন ঘটনা— আজ পর্যন্ত রাজ্য-রাজনীতি এমন বস্তু দেখেনি।

Advertisement

সাধারণ মৌলিক পার্থক্য নিয়ে জোটগঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলি সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে তার অবকাশ ছিল না। তাই আসন রফার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অপশাসন থেকে রাজ্যকে মুক্ত করার জন্য সমস্ত বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় এবং বিরোধী ভোট ভাগাভাগি পরিহার করে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থী নিশ্চিত করা যায়। এতেই মমতাদেবীর কপালে ভাঁজ পড়েছে। অথচ এই জোটগঠনের সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন মমতাদেবী স্বয়ং। অনেকে এই জোট গঠনে বাম-কংগ্রেস নেতৃত্বের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা বা বাস্তববোধকে বাহবা দেন, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় যে, এই জোটগঠনের আসল কারিগর হলেন মমতাদেবীই।
কী ভাবে? ঘটনা হল, গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজ্যে ক্ষমতাসীন হলেও মমতাদেবীর জমানায় কায়েম হয়েছে স্বকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র। রাজ্যে আইনের শাসন নেই, বদলে চলেছে মুখ্যমন্ত্রীর মর্জির শাসন। রাজ্যে কায়েম হয়েছে এক লুম্পেনরাজ, গুন্ডা-মস্তানরা বুঝে গিয়েছে তাদের শাসন করার কেউ নেই। এর ফলে রাজ্য জুড়ে মস্তানদের হামলা, খুন-জখম, তোলাবাজি, সিন্ডিকেটের দাপট, যত্রতত্র ধর্ষণ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রাজ্য জুড়ে গুন্ডা-মস্তানদের দাপটে পুলিশ-প্রশাসন পঙ্গু। আর এই সব দুষ্কৃতী দিয়েই রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার অপচেষ্টা সমানে চলেছে, এদের দিয়েই ছলে-বলে-কৌশলে ভোট ম্যানেজ করে একের পর এক নির্বাচনে জয় হাসিল করা গিয়েছে। অসংখ্য ঘটনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই সত্য, আজ রাজ্যবাসীর সকল গণতান্ত্রিক অধিকার লুণ্ঠিত, এমনকী নিজের ভোট নিজে দেওয়ার অধিকার নেই। এ সবের ফলেই রাজ্যে মানুষজনের দাবিতে সমস্ত বিরোধী দল জোটবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছেন। তাই অনায়াসে বলা যায় যে এই জোটের আসল রূপকার মমতাদেবী নিজেই।
এই জোটের পাল্টা হিসেবে মমতাদেবী নিজে বিজেপিকে নিয়ে জোট গঠন করতে পারতেন। যেহেতু বাম-কংগ্রেস জোটের টার্গেট হল, কেন্দ্রে বিজেপি ও রাজ্যে টিএমসি সরকার, তাই মমতাদেবী স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে বিজেপিকে পেতেই পারতেন। কিন্তু মুশকিল হল, বিজেপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে রাজ্যে ২৮ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট থেকে তাঁকে হাত ধুয়ে ফেলতে হত। এটা সম্ভব নয়। অতঃপর পথ একটাই। প্রকাশ্য জোট গঠন না করে প্রতিটি কঠিন সন্ধিক্ষণে বিজেপির পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে পারস্পরিক বোঝাপড়া। কিন্তু এ ধরনের বোঝাপড়া দিয়ে চিটফান্ডে সিবিআই তদন্তের গতি শ্লথ করা যায় বা স্টিং কাণ্ডে কার্যকর পদক্ষেপ থেকে বিজেপিকে বিরত রাখা যায়, কোনও স্থায়ী রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন ‘বোঝাপড়া’র কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। তাই মমতাদেবীর ‘একলা চলা’র দৃপ্ত ঘোষণা! এই ঘোষণায় বাহাদুরি আছে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই।
অতএব, কংগ্রেস-বাম জোটকে নীতিহীন আদর্শহীন সুবিধাবাদী জোট বলে আক্রমণ শানানো ছাড়া মমতাদেবীর অন্য কোনও পথ নেই। ঘটনা হল, এই দল অকাতরে কখনও কংগ্রেস কখনও বিজেপির হাত ধরেছে। তবু নীতি-আদর্শ-সুবিধাবাদের বুলি কপচানোর কারণ ভিন্ন। সকলেই জানেন, বামপন্থীদের ভোট দিতে কংগ্রেসিদের বা কংগ্রেসিদের ভোট দিতে বামপন্থীদের গভীর বিরাগ সাধারণ কর্মীদের মনে নিহিত রয়েছে। সেটাকে উস্কে দিতেই এত নীতি-আদর্শের অবতারণা।
কিন্তু এর থেকেও বিস্ময়কর হল, পণ্ডিতদের একাংশ মমতাদেবীর ভাষাতেই নীতি-আদর্শের কথা তুলে এই জোটকে আক্রমণ করেছেন, যেন এই প্রকার জোট-গঠন মানে নীতি-আদর্শকে জলাঞ্জলি দেওয়া। নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে বিস্তর ফারাক, কিন্তু ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে নীতি-আদর্শ রক্ষার জন্যই এই প্রকার বোঝাপড়া অনিবার্য হয়েছে। হিটলারের জার্মান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানবসভ্যতাকে রক্ষার জন্য এ ভাবেই স্তালিন সাহেব চার্চিল-রুজভেল্টের হাত ধরেছিলেন। চিনের উদাহরণও স্মরণীয়। ১৯২৭ সালে চিয়াং কাই শেক কমিউনিস্ট নিধন অভিযান শুরু করে শহরে ও গ্রামে প্রায় সব কমিউনিস্টকে হত্যা করেন। কিন্তু ১৯৩১ সালে জাপানের চিন আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কমরেডদের রক্তে রঞ্জিত চিয়াং কাই শেকের হাত ধরতে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধা করেনি। এর ফলেই চিনের স্বাধীনতা রক্ষিত হয় ও পরে চিন বিপ্লব সম্ভব হয়। এ দেশেও ‘জরুরি অবস্থা’র সময় গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য সমস্ত বিরোধী দলগুলি হাত মেলাতে বাধ্য হয়েছিল।
আসলে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র এতই হিংস্র ও আগ্রাসী যে শুধু শোষিতদের নয়, শোষকদের একাংশকেও আঘাত করে। ফলে উদ্ভূত হয় সেই ঐতিহাসিক সুযোগ যেখানে শোষিতদের সঙ্গে শোষকদের একাংশও সংগ্রামে যোগ দিতে বাধ্য হয়। সর্বদেশে সর্বকালে এই সুযোগ নিয়েই ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্রকে পরাজিত করা গেছে। তাই এই প্রকার জোটগঠন কখনও অনৈতিক নয়। কথা উঠতে পারে, এই সব দৃষ্টান্ত যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু সংসদীয় সংগ্রাম তো রাজনৈতিক সংগ্রাম। মাও ৎসে তুংয়ের ভাষায়, ‘যুদ্ধ হল রক্তপাতযুক্ত রাজনীতি আর রাজনীতি হল রক্তপাতহীন যুদ্ধ।’
মজার কথা হল, বামপন্থীদের একাংশও এই জোটের বিরোধিতায় বিভেদপন্থী অবস্থান নিয়েছেন। এরই প্রভাবে এমনকী বামফ্রন্টের চেয়ারম্যানও সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করে বসেন যে, ‘কংগ্রেস ও বাম দল যৌথ মঞ্চ বা যৌথ প্রচার করবে না’ বা ‘হাত-হাতুড়ি এক নয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। হাত ও হাতুড়ি যে এক নয়, সেটা সবাই জানেন। ব্যক্তি হিসেবে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান যে সহজ সরল সংগ্রামী ভাল মানুষ, সেটাও কারও অজানা নয়। কিন্তু জোট ঘোষণার মঞ্চ থেকে হাত ও হাতুড়ির ভিন্নতাকে তুলে ধরে যৌথ প্রচার নাকচ করার ঘোষণা জোটপ্রক্রিয়াকে তছনছ করার শামিল। আসলে এখানে জোটের পাটিগণিতেই নজর দেওয়া হয়েছে, জোটের রসায়নে নজর পড়েনি।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পায় ৩৯ শতাংশ ভোট, বামফ্রন্ট ২৯ শতাংশ, কংগ্রেস ৯ শতাংশ। কংগ্রেস ও বামের মিলিত ভোট ৩৮ শতাংশ, যা টিএমসি’র চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ কম। কিন্তু বিজেপি পেয়েছিল ১৬ শতাংশ ভোট। এখন সেই ভোট অনেক কমে ৬ শতাংশ মতো দাঁড়াবে। বাকি ১০ শতাংশ কোথায় যাবে? হিসেব বলছে, এই ভোটের ৫ শতাংশ পাবে বামেরা, ৩ শতাংশ পাবে টিএমসি, বাকি ২ শতাংশ কংগ্রেস। তা হলে পাটিগণিত হল: টিএমসি ৪২ শতাংশ, বাম-কংগ্রেস জোট ৪৫ শতাংশ।
মুশকিল হল, বাম ও কংগ্রেসের ভোট এক জায়গায় আনা খুবই কঠিন। সেখানেই জোটের রসায়নের ভূমিকা। এখানে যৌথ মঞ্চ ও যৌথ প্রচার জনসাধারণের মনোবল বাড়াবে, কর্মীদের জড়তা কাটবে, মানুষজন সন্ত্রাস, ভয় অতিক্রম করে এগিয়ে আসবেন। এই রসায়ন কাজ না করলে পাটিগণিতের অঙ্ক লেখাই থাকবে, ভোটব্যাঙ্কে পড়বে না। আমাদের বামপন্থী নেতারা বামপন্থী গ্রামার ঠিক রাখতে গিয়ে এখানে ট্রানস্লেশনকে গুবলেট করে দেন!
ভোটযুদ্ধে তৃণমূলের হাল কী? গত পাঁচ বছর ধরে মেলা খেলা উৎসব, বিপুলসংখ্যক ক্লাবকে অনুদান, দু’টাকা কিলো দরে চাল, কন্যাশ্রী, সবুজসাথী ইত্যাদি প্রকল্পে অনুদানের ভিত্তিতে রাজ্য জুড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের এক সমর্থনভূমি যে তৈরি হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা মিছিল সমাবেশে কাজ দিলেও ভোটে কতটা কাজ দেবে, তা কারওই জানা নেই। কর্মসংস্থানে মানুষ স্বাবলম্বী হন, অনুদান মানুষকে স্তাবক বানায়। তা ছাড়া, তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনভিত্তিতে দুটি রোগ। এক, দলের মধ্যে প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব। টিএমসি’তে আদর্শের বন্ধন খুবই শিথিল। বাম জমানায় তীব্র সিপিএম-বিরোধিতা দলীয় ঐক্য গঠনে আঠার কাজ করত। ক্ষমতাহীন, হতবল বামদের বিরুদ্ধে সে রোষ অনেকাংশে প্রশমিত। ফলে ক্ষমতা ও বখরা নিয়ে দ্বন্দ্বে দল বিপর্যস্ত। লক্ষণীয়, আগে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাত গ্রামীণ বিবাদে প্রধান উপাদান ছিল, এখন তৃণমূল বনাম তৃণমূল বিবাদই গ্রামীণ সংঘাতের প্রধান উপাদান। দুই, এই রাজ্যে নির্বাচনে দুর্নীতি কোনও সময়েই তেমন পাত্তা পায়নি। কিন্তু নেতা-মন্ত্রীরা টাকা নিচ্ছেন, চোখের সামনে এই ছবি, এবং তা নিয়ে দলের উল্টোপাল্টা ও স্ববিরোধী বক্তব্য ক্রমশই জনমানসে প্রভাব ফেলছে। এই অবস্থায় একা কুম্ভ টিএমসি কতটা দুর্গ রক্ষা করবে, তা নিয়ে সংশয় ক্রমবর্ধমান।
কিন্তু এ সব সত্ত্বেও মানুষজন নির্বাচন কমিশনের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে সংশয়াকুল। নিজের ভোট কি নিজে দেওয়া যাবে? আমার মতে, ব্যক্তিগত কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কঠোর ও নিরপেক্ষ হবে। কমিশনের সদস্যরা ঝানু আমলা। রাজনৈতিক হাওয়া কোন দিকে বইছে ও বইবে, সে খেয়াল তাঁরা রাখেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সম্ভাব্য পালাবদলও তাঁদের হিসেবে আছে। সে দিকে নজর রেখেই নির্বাচন কমিশন পদক্ষেপ করবে।
সুতরাং বলা যায়, মমতাদেবী কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই অনিবার্য। রাজ্যে পালাবদল হবে কি না জানি না, কিন্তু টিএমসি’র আসনসংখ্যা কমবেই। এই সংখ্যা যদি দেড়শোর নীচে নামে, তবে মমতাদেবীর পক্ষে দল বা সরকার ধরে রাখা সম্ভব হবে না। অন্য দিকে, বাম-কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় এলেও সেই সরকারও দীর্ঘস্থায়ী হবে না। উভয় ক্ষেত্রেই, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তার আয়ু বেশি দিন হবে না, বছর দুয়েকের মধ্যে আবার নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়তে পারে। তা হলে আর লাভটা কী? লাভ একটাই: রাজ্য জুড়ে বিদ্যমান মাৎস্যন্যায় থেকে মানুষজনের মুক্তি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement