বিপ্লব মিত্র। —ফাইল চিত্র।
সাতটির মধ্যে চারটি বিধানসভাতেই ‘লিড’। শুধু তা-ই নয়, ‘লিড’ বে়ড়েছে গত বারেরও থেকেও। তার পরেও বালুরঘাটে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কাছে কেন হেরে গেলেন রাজ্যের মন্ত্রী বিপ্লব মিত্র, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। শাসকদলের অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছে দুই কারণ।
মঙ্গলবার ভোটগণনা শুরু হওয়ার পর থেকেই নাটকীয় লড়াই দেখা গিয়েছিল সুকান্ত এবং বিপ্লবের মধ্যে। কখনও সুকান্ত এগিয়ে যাচ্ছিলেন, কখনও আবার বিপ্লব। তবে অধিকাংশ সময় ধরে রাজ্যের মন্ত্রীই এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে সন্ধ্যার পর থেকে। বিপ্লবকে টপকে এগিয়ে যেতে থাকেন সুকান্ত। শেষমেশ জিতেও যান। পুনর্গণনার দাবি তুলেও সুবিধা করতে পারেনি তৃণমূল। রাতে পুনর্গণনার পরে সুকান্তের জয়ের ব্যবধান দাঁড়ায় ১০,৩৮৬ ভোট। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি হল? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, এর অন্যতম কারণ—মূলত শহর এলাকায় সাংগঠনিক দুর্বলতা।
তৃণমূল সূত্রে খবর, ভোটের ফলাফল কাঁটাছেড়া করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, তৃণমূলের বহু পদাধিকারী নিজের বুথেই দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে পারেননি। জেলা সভাপতি সুভাষ ভাওয়ালের ২০৮ ও ২০৯ নম্বর বুথে তৃণমূল পিছিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশোর বেশি ভোটে। গঙ্গারামপুর বিধানসভা এলাকায় ১৬৮০০ ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। প্রার্থী বিপ্লবের ভাই প্রশান্ত মিত্র গঙ্গারামপুর পুরসভার চেয়ারম্যান। তিনি ৭ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সেই ওয়ার্ডেই ১০৩ ভোটে হেরেছেন বিপ্লব। গঙ্গারামপুর পুরসভার উপ পুরপ্রধান জয়ন্ত দাস দলের মুখপাত্র। তাঁর ১৫ ওয়ার্ডেও তৃণমূল পিছিয়ে রয়েছে। জেলা সভাপতি সুভাষ বলেন, ‘‘বালুরঘাটের মানুষ সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। আমরা কেন এই ভোটারদের মন জয় করতে পারছি না, তার পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে বালুরঘাট, তপন ও গঙ্গারামপুরের ফলাফল আমাদের খুবই আশ্চর্য করেছে। এ বার আমরা আরও ভাল ফলাফল আশা করেছিলাম। কিন্তু হয়নি। সব কিছুরই পর্যালোচনা হবে।’’
বিধানসভা ভিত্তিক ভোটের ফলাফলে দেখা গিয়েছে, সংখ্যালঘু প্রধান বিধানসভা কেন্দ্র ইটাহার থেকে ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজেপিকে পিছনে ফেলেছে তৃণমূল, যা গত লোকসভার তুলনায় বেশি। আর এক সংখ্যালঘু প্রধান বিধানসভা কুমারগঞ্জেও গত বারের তুলনায় পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধান বেড়েছে তৃণমূলের পক্ষে। রাজবংশী প্রধান কুশমণ্ডি থেকে তৃণমূলের ‘লিড’ বেড়েছে চার হাজারেরও বেশি। মন্ত্রী বিপ্লবের নিজের বিধানসভা হরিরামপুর থেকেও তৃণমূলের ‘লিড’ গত লোকসভার প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু বাকি তিন বিধানসভা কেন্দ্র— বালুরঘাট, তপন ও গঙ্গারামপুরের ‘লিডেই’ জিতেছেন সুকান্ত।
বালুরঘাট বিধানসভায় ৪০ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে ছিলেন বিজেপি। তৃণমূল সূত্রে খবর, বালুরঘাট পুরসভার ২২টি ওয়ার্ড থেকেই প্রায় ২২ হাজার ভোটের লিড পেয়েছে বিজেপি। যা গত বারের থেকেও বেশি। ২০১৯ সালের ভোটে বালুরঘাট শহরে তৃণমূলের থেকে ১৭ হাজারের সামান্য বেশি ভোট পেয়েছিলেন সুকান্ত। পরে বিধানসভা ভোটে সেই জমি অনেকটাই পুনরুদ্ধার করে তৃণমূল। কিন্তু লোকসভা ফের একের পর এক ওয়ার্ডে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে দলকে। বালুরঘাট পুরসভার চেয়ারম্যান অশোক মিত্রের ওয়ার্ডেই ৬৮১ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন বিপ্লব। প্রাক্তন মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তীর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৩৪ ভোট, শহর সভাপতি প্রিতমরাম মণ্ডলের ওয়ার্ডে ৭৮১ ভোটে পিছিয়ে ছিল দল।
এ বিষয়ে তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি মৃণাল সরকার অবশ্য বলেন, ‘‘এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। আরও কাঁটাছেড়া হওয়া প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে ভোট ভাল হলেও কেন শহর এলাকায় পিছিয়ে গেল দল, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কোনও জায়গায় যদি সাংগঠনিক দুর্বলতা থেকে থাকে, সেগুলো মেরামত করার প্রয়োজন রয়েছে। দলীয় নেতৃত্ব নিশ্চয়ই গ্রামের পাশাপাশি শহরের সংগঠনের দিকেও নজর দেবেন। দল কী কারণে হেরে গেল, তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’’
বিপ্লবের হারের নেপথ্যে আরও একটি কারণের কথা উঠে এসেছে। তা হল— অন্তর্ঘাত। ভোটের ফল প্রকাশের পর মন্ত্রী নিজেই সেই অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘দলের কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে। বিজেপি আগাম কিছু জায়গার ফল বলে দিচ্ছিল, যা মিলে গিয়েছে।’’ যদিও এই অন্তর্ঘাতের তত্ত্ব দলের অনেকেই মানতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকেরাই ভোটের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদের উপরেই ভরসা করেছিলেন মন্ত্রী। তাঁরা অন্তর্ঘাত করবেন, এ কথা বিশ্বাস করা একটু কষ্টকর। বরং কারও কারও মত, যাঁদের উপর ভরসা করে নির্বাচনে লড়েছেন বিপ্লব, ভোটের ফলাফল থেকে স্পষ্ট যে, তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। সেই কারণে জেলা সভাপতিকে নিজের বুথে হারতে হয়েছে। হারতে হয়েছে বিপ্লবের ভাইকেও। এই পরিস্থিতিতে জেলায় নেতৃত্ব বদলেরও দাবি উঠতে শুরু করেছে।