গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শ্রীরামপুরে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান নতুন নয়। সেটা অবশ্য মূলত শ্রীরামপুর বিধানসভা আসনে। গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে এই লোকসভা আসনের মধ্যে একমাত্র শ্রীরামপুরেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয় পায় তৃণমূল। ফলে ৭-০ ফলাফলে এগিয়ে থাকা তৃণমূল দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে নিশ্চিন্তেই থাকতে পারত। কিন্তু তা হওয়ার জো নেই। গত পাঁচ বছর ধরে এই আসনের অনেকটা এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা দিয়ে অনেক স্রোত বয়ে গিয়েছে। তাই টানা তিন বার জিতেও স্বস্তি নেই তৃণমূলের। কারণ, গত বিধানসভা নির্বাচনে শ্রীরামপুরেই হেরে যাওয়া কবীরশঙ্কর বোসের পক্ষে অযোধ্যার ‘রামলালার হাওয়া’ কাজ করতে পারে। কারণ, এই লোকসভার ভোটারদের একটা বড় অংশ হিন্দিভাষী। আবার সিপিএম প্রার্থী দীপ্সিতা ধরকেও ছোট করে দেখা যাবে না। অঙ্ক বলছে, জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা নিতে পারে তাঁর পাওয়া ভোট।
শ্রীরামপুর লোকসভা আসনের একটি অনন্য পরিচয় রয়েছে। এই আসন প্রায় প্রতি বারেই সাংসদ বদল করেছে। দলও বদল করেছে। টানা তিন বার জেতার নজির খুব কমই। ১৯৭১, ১৯৭৭ এবং ১৯৮০ সালে পর পর জিতেছিলেন সিপিএমের দীনেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। এর পরে সে নজির শুধু তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই গড়েছেন। এ বার তাঁর চতুর্থ বারের লড়াই। জয় পেলে রেকর্ড গড়বেন তিনি।
স্বাধীনতার পর থেকে দেখা গেলে সিপিএম-কংগ্রেস, সিপিএম-কংগ্রেস এই ভাবে ‘লেফট-রাইট-লেফট’ করে গিয়েছে শ্রীরামপুর। বদলটা নিয়ে আসেন আকবর আলি খন্দকার। গোটা হুগলি জেলাই তখন খন্দকারের। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত প্রিয় এই নেতা ১৯৯৬ সালে চণ্ডীতলা বিধানসভায় জেতেন। ১৯৯৮ সালে তিনি একাধারে জেলা সভাপতি এবং শ্রীরামপুরের সাংসদ। ১৯৯৯ সালের ভোটেও সাংসদ হন। তবে ২০০৪ সালে ফের সিপিএমের শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হেরে যান আকবর। পরের বছরেই অকালমৃত্যু হয় তাঁর। জেলার হাল ধরেন তপন দাশগুপ্ত। ২০০৯ সাল থেকে শ্রীরামপুর লোকসভা আসনে জয় নিশ্চিত করেন কল্যাণ।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তবে আকবরের সময় থেকেই কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে চলে যায়। ১৯৯৬ সালে সাংসদ হওয়া কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং তাঁর দল ক্রমেই পিছনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। ২০০৯ সালে বিজেপি শ্রীরামপুর লোকসভা নির্বাচনে তৃতীয় স্থানে থেকে প্রার্থী দেবব্রত চৌধুরী পেয়েছিলেন মাত্র ৩৮,৪৭৬ ভোট। শতাংশের হিসাবে ৩.৫৫ শতাংশ। তৃণমূলের ছিল ৫৩.৪৮ শতাংশ ভোট। সিপিএমের তখনও ৩৯.৯৯ শতাংশ। সেই সিপিএম ২০১৪ সালে কমে ২৮.০৮ শতাংশ। বিজেপি প্রার্থী সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার বাপ্পি লাহিড়ি পান ২২.২৯ শতাংশ ভোট। সে বারেও তিনেই ছিল বিজেপি। কিন্তু ২০১৯ সালে পদ্মপ্রার্থী দেবজিৎ সরকার দ্বিতীয় হন ৩৮.৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে। কল্যাণ জেতেন প্রায় এক লক্ষ ভোটের ব্যবধানে।
এই অঙ্কই বলে দিচ্ছে, শ্রীরামপুর এখনও তৃণমূলের ‘গড়’। প্রার্থী কল্যাণের নিশ্চিন্ত থাকারই কথা। ‘গরম গরম’ কথা বলার জন্য পরিচিত কল্যাণ। বিজেপি এবং সিপিএম প্রার্থী সম্পর্কেও নানা উপমা দিয়ে চলেছেন। তবে প্রতিপক্ষের কবীরশঙ্করের থেকে কল্যাণের আক্রমণের ঝাঁজ বেশি বরাদ্দ দীপ্সিতার জন্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’র প্রথম লাইনের মতো বলা যেত কবীরশঙ্কর ব্যারিস্টার। কিন্তু ঘটনাচক্রে, তিনি কল্যাণের প্রাক্তন জামাই। লোকসভা এলাকায় এই পরিচয়টাই বেশি করে চেনাচ্ছে কবীরকে। তাঁর দল প্রচারে ‘লিঙ্কন্স ইন’-এর বার-অ্যাট-’ল হিসাবে কবীরকে তুলে ধরতে চাইছে। কিন্তু প্রাক্তন হলেও শ্বশুরমশাইয়ের নামটা এসেই যাচ্ছে। কল্যাণ তো নিজেই বলেছেন, “কে চেনে ওকে! আমার পরিচয়েই তো শ্রীরামপুরে ওর পরিচয়। ওর বাবাকেও কি কেউ চেনে এখানে?” যা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি।
বিতর্ক আরও রয়েছে। উত্তরপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রে নিজের দলের বিধায়ক তথা অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিককে প্রচার গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছেন কল্যাণ। যুক্তি: গ্রামাঞ্চলে মহিলারা একাধিক বিয়ে করা কাঞ্চনকে দেখলে ‘রিঅ্যাক্ট’ করছেন। ঠোঁটকাটা ব্যবহার নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে কল্যাণের ‘সুনাম’ রয়েছে। তবে এ সবে পাত্তা না দেওয়া কল্যাণের দাবি, “আমি এমনই। আমাকে শ্রীরামপুর কেন্দ্রের ভোটাররা এই ভাবেই চেনেন। এ বারেও তাঁরা আমাকেই ভোট দেবেন।’’ কল্যাণ মনে করেন ‘দিদি’ই সব। তাঁকে দেখেই ভোট। ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর বিবিধ মন্তব্য একটা সময়ে ঝড় তুলেছিল শাসক শিবিরের অন্দরে। কিন্তু সে সবে ‘শান্তিকল্যাণ’ হয়েছে।
উত্তরপাড়া, জগৎবল্লভপুর, ডোমজুড়, শ্রীরামপুর, চাঁপদানি, চণ্ডীতলা, জাঙ্গিপাড়া। সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই বিধায়ক তৃণমূলের। শ্রীরামপুর লোকসভায় ইদানীং বিজেপির ভোট বাড়লেও বেশির ভাগ জায়গায় সংগঠন মজবুত নয়। তাই মনে করা হচ্ছে দীপ্সিতাই ‘ভরসা’। সিপিএম প্রার্থী কার ভোট কতটা কাটবেন, তার উপরে অনেকটা নির্ভর করছে শ্রীরামপুরের ফলাফল। নীলবাড়ির লড়াইয়ে বালি আসনে পরাজিত দীপ্সিতা এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। তবে এই আসনের সঙ্গে তাঁর একটি পারিবারিক সূত্রও রয়েছে। ডোমজুড় বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে দীপ্সিতার দাদু পদ্মনিধি ধর সিপিএমের টিকিটে টানা তিন বার জিতেছিলেন। লড়াই যে রয়েছে, তা প্রবীণ কল্যাণ বনাম নবীনা দীপ্সিতার লাগাতার কথা কাটাকাটিতে স্পষ্ট। দীপ্সিতা ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ বলেছিলেন কল্যাণকে। পাল্টা দীপ্সিতাকে ‘মিস ইউনিভার্স’ এবং ‘সোফিয়া লোরেন’ আখ্যা দিয়েছেন কল্যাণ।
সিপিএমের প্রচারে ঝাঁজ থাকলেও দীপ্সিতার পথে একটি ‘কাঁটা’ রয়েছে। জোট ঠিকঠাক না হওয়ায় নওশাদ সিদ্দিকির দল আইএসএফ প্রার্থী দিয়েছে শ্রীরামপুরে। সেই প্রার্থী শাহরিয়ার মল্লিককে একেবারে ছোট করে দেখছেন না কেউ। কারণ, তাঁর দলের ‘প্রাণকেন্দ্র’ ফুরফুরা শরিফ শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেই। মুসলিম অধ্যুষিত জগৎবল্লভপুর, ডোমজুড় আসন কল্যাণকে বরাবার বড় ব্যবধানে এগিয়ে দিয়েছে। সেই ভোটব্যাঙ্ক কি এ বারে তিন ভাগ হয়ে যেতে পারে? উত্তরের সন্ধানে চার পক্ষ।