ভোটের প্রচারের ফাঁকে গোরক্ষনাথের পুজো যোগী আদিত্যনাথের। রবিবার, গোরক্ষপুরে। — নিজস্ব চিত্র।
‘লাপাতা লেডিজ়’-এর পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয়ের সময় রবি কিষনকে নাকি শ’দেড়েক পান খেতে হয়েছিল!
চরিত্র ফুটিয়ে তোলার স্বার্থে গাল পুড়ে গেলেও রবি কিষন না করেননি।
যোগী আদিত্যনাথের গোরক্ষপুরে এলে দেখা যাবে, গোরক্ষপুরের বিজেপি সাংসদ তথা এই লোকসভা ভোটে ফের বিজেপির প্রার্থী রবি কিষনের নামের পাশে শুক্ল পদবি লেখা রয়েছে। যিনি ভোজপুরী বা হিন্দি ছবি থেকে ওটিটি-র পর্দায় রবি কিষন নামেই বেশি পরিচিত, তাঁকে হঠাৎ শুক্ল পদবি ব্যবহার করতে হচ্ছে কেন? রবি হেসে বলেন, ‘‘আমার আসল নাম তো রবীন্দ্র কিষন শুক্ল। সিনেমার জগতে ছোট হয়ে রবি কিষন হয়ে যায়।’’
যেটা বলবেন না, অভিনয়ের প্রয়োজনে যেমন তাঁকে পান খেতে হয়, লোকসভা ভোটে জেতার প্রয়োজনে তাঁকে তেমনই নিজের ব্রাহ্মণ পরিচিতি কাজে লাগাতে হয়। গোরক্ষপুর কেন্দ্র— রবি কিষনের নিজের কথায়, উত্তরপ্রদেশে বারাণসীর পরেই ‘হটেস্ট সিট’। কারণ বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদী প্রার্থী। আর গোরক্ষপুরে? রবি কিষন শুক্ল শুধু নামেই। প্রার্থী আসলে যোগী আদিত্যনাথ। গোরক্ষপুরে যাঁর একটাই নাম, ‘বাবা’। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। গোরক্ষনাথ মন্দিরের মহন্ত, পীঠাধীশ্বর। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার আগে গোরক্ষপুর থেকে টানা পাঁচ বার সাংসদ হয়েছিলেন আদিত্যনাথ। তাঁর আগে তাঁর গুরু মহন্ত অবৈধ্যনাথ ও মহন্ত দিগ্বিজয়নাথও গোরক্ষপুরের সাংসদ ছিলেন। গোরক্ষপুরে ১ জুন ভোট। যেন অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে। মোদীর বারাণসীতে বিজেপি বেশি ব্যবধানে জিতবে? না কি যোগীর গোরক্ষপুরে?
গোরক্ষনাথ মন্দিরে ভিড় করা ১০ জনের মধ্যে ৯ জন ভক্তকে প্রশ্ন করলে উত্তর মিলবে, ‘‘কোনও প্রতিযোগিতা নেই। লখনউতে যোগীজি। দিল্লিতে মোদীজি। ভবিষ্যতে দিল্লিতে যোগীজি!’’ যোগীকে ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাওয়ার গোরক্ষপুরের এই স্বপ্নই যেন প্রতিযোগিতা উস্কে দিচ্ছে।
রবিবার রবি কিষনের হয়ে গোরক্ষপুরে জনসভার পরে যোগী বলেছেন, ‘‘শিবের অবতার মহাযোগী গুরু গোরক্ষনাথের পবিত্র শহর গোরক্ষপুরে বিজেপির জয় আগে থেকেই নিশ্চিত হয়ে রয়েছে। ১ জুন এখানকার ভোটাররা জয়ের নতুন রেকর্ড তৈরির জন্য ভোট দিতে যাবেন।’’ রবিও যোগীর ভরসাতেই। রবি তাই প্রচারে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অযোধ্যা, বারাণসী, মথুরার মতো গোরক্ষপুরও মন্দির-নগরী।
মন্দির-নগরী বটে। কিন্তু গোরক্ষপুরে ‘মন্দির-হাওয়া’ই নেই। তার বদলে জাতপাতের অঙ্ক কষা চলছে। আদিত্যনাথ ২০১৭-য় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সাংসদ হিসেবে পদত্যাগ করেছিলেন। তার পরেই উপনির্বাচনে বিজেপি হেরে যায়। এসপি ও বিএসপি সেই ভোটেই প্রথম জোট করেছিল। এসপি-র হয়ে জিতেছিলেন প্রবীণ নিষাদ। পেশায় মাঝি-মাল্লার। অনগ্রসর শ্রেণির। এসপি এ বার অভিনেতা রবি কিষনের বিরুদ্ধে ভোজপুরী অভিনেত্রী কাজল নিষাদকে প্রার্থী করেছে। বিজেপির পাখির চোখ ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভূমিহার ও বৈশ্য সম্প্রদায়ের ভোট।
উচ্চবর্ণের ভোটকে নজরে রেখেই রবি কিষন তাঁর পদবী যে শুক্ল, তিনি যে ব্রাহ্মণ সন্তান, মনে করিয়ে দিচ্ছেন। বিজেপি মনে করছে, দলিত ভোটব্যাঙ্কের একাংশ বিজেপির ঝুলিতে আসবে। মায়াবতী মুসলিম প্রার্থী দেওয়ায় এসপি-র মুসলিম ভোট বিএসপি কাটবে। সর্বোপরি সঞ্জয় নিষাদের নিষাদ পার্টিও বিজেপির শরিক। তারাও এসপি-র নিষাদ ভোটে ভাগ বসাবে। ‘ইন্ডিয়া’র অঙ্ক, নিষাদের সঙ্গে যাদব-মুসলিম ভোট এক হলে জয় না আসুক, ব্যবধান কমানো যাবে।
জাতপাতের এই অঙ্কের সঙ্গেই যোগ হয়েছে চাকরির অভাব নিয়ে ক্ষোভ। গোরক্ষপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ-র ছাত্র সঞ্জীব রাজভড়ের ক্ষোভ, ‘‘রেল, স্টাফ সিলেকশন কমিশনের পরীক্ষায় আগের মতো নিয়োগ হচ্ছে না। চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে। বন্ধুদের অনেকে সেনায় চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অগ্নিবীর-এ সেনায় পাকা চাকরির বন্দোবস্তও বন্ধ হয়ে গেল।’’
বিজেপি নেতারা অবশ্য দাবি করছেন, লোকসভা ভোটে জাতপাতের অঙ্ক, কর্মসংস্থান নিয়ে ক্ষোভ সব ধামাচাপা পড়ে যাবে। দৌড়বে ‘ডাবল ইঞ্জিন’। এক দিকে মোদী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের ‘লাভার্থী’। অন্য দিকে যোগী সরকারের ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ রাখার নীতি। গোটা পূর্বাঞ্চলে এখন শান্তি। ‘বুলডোজ়ার’-এ মাফিয়ারাজ ধূলিসাৎ। গোরক্ষপুরে রাত ১২টায় মহিলারা স্কুটি চালিয়ে ঘুরছেন। গোরক্ষপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক মহেন্দ্র কুমার সিংহও মানছেন, ‘‘গোরক্ষপুর-সহ উত্তরপ্রদেশে যোগীর আমলে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে তা বিজেপিকে লড়াইয়ে এগিয়ে দেবে।’’
গোরক্ষপুরের রামগড় তাল সরোবর এক সময় ‘খুনি নালা’ নামে পরিচিত ছিল। সেই রামগড় তাল এখন সেজে তৈরি। ভাসমান রেস্তরাঁ, পাঁচতারা হোটেল, বিলাসবহুল ক্রুজ়। যোগী মেট্রো রেল চালুর স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এমস তৈরি হচ্ছে। এক কালের ‘খুনি নালা’ রামগড় তালে এখন মোবাইলে ‘রিল’ তোলা হচ্ছে। যোগীর ইচ্ছে, তাঁর ‘স্বপ্নের গোরক্ষপুর’ ভবিষ্যতে ওটিটি-র ওয়েবসিরিজ শ্যুটিংয়ের মক্কা হয়ে উঠবে। নয়া গোরক্ষপুর কি গোরক্ষনাথ যোগীকে প্রধানমন্ত্রীর গদির দিকে এগিয়ে দেবে?
গোরক্ষনাথ মঠের দফতরে গোরক্ষনাথ মন্দিরের সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট চালান বিনয় কুমার গৌতম। পীঠাধীশ্বরের ছবি, কাজকর্ম আপলোড করা তাঁর কাজ। প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসেন। নীরবতাই গোরক্ষপুরের আকাঙ্ক্ষা বুঝিয়ে দেয়।