প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
‘‘আপনাদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা নাকি বলছে, বিজেপি এ বার একার জোরে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না?’’
প্রশ্ন শুনে পান-ভর্তি মুখে হেসে ওঠেন আরএসএস প্রচারক। তার পর পাল্টা চ্যালেঞ্জের সুরে বলেন, “যারা আরএসএসের গোপন খবর দেয়, তাদের জিজ্ঞাসা করুন তো, উত্তরপ্রদেশে আরএসএসের কত জন প্রান্ত প্রচারক রয়েছেন? উত্তরপ্রদেশে আরএসএসের সংগঠন কতগুলো প্রান্তে বিভক্ত? যারা এটাই বলতে পারে না, তারা নাকি আরএসএসের গোপন সমীক্ষার কথা জানতে পারে!”
লোকসভা নির্বাচন হোক বা উত্তরপ্রদেশ-সহ হিন্দি বলয়ের বিধানসভা নির্বাচন— আরএসএসের স্বয়ংসেবকদের অদৃশ্য উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষকে জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত করা বা ভোট দেওয়ার গুরুত্ব বোঝানোয় সঙ্ঘ পরিবারের অজস্র সংগঠন ও তার সঙ্গে যুক্ত আরএসএস প্রচারকরা নীরবে কাজ করে চলেন। অথচ তাঁরা ভোট নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে মুখ খুলতেই চান না। উত্তর মেলে, আরএসএস সাংস্কৃতিক সংগঠন। আরএসএসের সঙ্গে নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক নেই।
অনেক চেষ্টার পরে আরএসএসের অওয়ধ প্রান্তের এক প্রচারকের দেখা মিলল লখনউয়ে। আবশ্যিক শর্ত, নাম গোপন থাকবে। এবং প্রথমেই প্রচারক জানিয়ে দিলেন, তাঁদের মতে মোদী সরকার বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় ফিরছে। হয়তো ‘চারশো পার’-এর লক্ষ্য পূরণ হবে না। তবে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বা ২০১৯-এর মতোই তিনশো আসন ছোঁয়া
কঠিন নয়।
কিন্তু নেট-দুনিয়ায় যে গুজব, আরএসএসের সমীক্ষা বলছে, বিজেপি এ বার ২৪০টি আসনে আটকে যাবে। আরএসএস প্রচারক বলছেন, “আমরা এমন কোনও সমীক্ষা করাইনি। ২০১৯-এ বিজেপি ৩০৩টি আসন জিতেছিল। আমার ব্যক্তিগত মত, বিজেপি এ বার ২৮০ থেকে ৩২০টি আসন পেতে পারে। বিজেপির নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশে এনডিএ ২০১৯-এ ৬৪টি আসন জিতেছিল। এ বারও কম-বেশি একই রকম আসন জিতবে বিজেপি।” তার পরে কঠিন মুখে বলেন, “আগামী বছর ২০২৫-এ আরএসএসের শতবর্ষ। তার আগে যে কোনও মূল্যে মোদী সরকারের ক্ষমতায় ফেরা জরুরি।”
গত মার্চে নাগপুরে আরএসএসের অখিল ভারতীয় প্রতিনিধিসভা বসেছিল। সেখানে আরএসএসের সাধারণ সম্পাদক পদে দত্তাত্রেয় হোসাবালের আরও তিন বছর মেয়াদ বেড়েছে। একই সঙ্গে উত্তরপ্রদেশে আরএসএসের সংগঠনে বড় রদবদল হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে আরএসএসের সংগঠন ছয়টি প্রান্তে বিভক্ত— কাশী, গোরক্ষ, অওয়ধ, কানপুর, ব্রজ ও মেরঠ। এর মধ্যে কাশী, গোরক্ষ ও ব্রজের প্রান্ত প্রচারক পদে বদল করা হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের মেঠো পথে ঘুরলে টের পাওয়া যায়, ছোট ছোট শহর-গ্রামে ছড়িয়ে থাকা আরএসএস কর্মীরা খুশি নন। নরেন্দ্র মোদী দশ বছর দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী পদে রয়েছেন। তিনি নিজে আরএসএস প্রচারক ছিলেন। সরাসরি সঙ্ঘ পরিবারের না হলেও গেরুয়াধারী যোগী আদিত্যনাথ সাত বছর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদে রয়েছেন। তা সত্ত্বেও আরএসএসের কর্মীদের অনেক প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অনেকেই বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের কাছে নানা সাহায্য চাইতে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন। তার মধ্যে ভোটের ভরা মরসুমে বিজেপির জাতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা বলেছেন, শুরুতে বিজেপি অক্ষম ছিল বলে আরএসএসের সাহায্যের প্রয়োজন হত। এখন বিজেপি সক্ষম। তাই বিজেপি নিজেই চলে।
আরএসএসের প্রচারক ফের হেসে বলেন, এই বিজেপি-আরএসএস টানাপড়েন সংবাদমাধ্যমের বানানো। নড্ডা যা বলেছেন, তা সত্যিই বলেছেন। আবার এটাও সত্যি, বিজেপির দুই প্রধানমন্ত্রী, অটলবিহারী বাজপেয়ী ও নরেন্দ্র মোদীই আরএসএসের প্রচারক হিসেবে কাজ শুরু করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০২৫-এ সঙ্ঘের শতবর্ষ। উত্তরপ্রদেশের আরএসএস নেতাদের মতে, তার আগে দেশের প্রতিটি গ্রামে শাখা খোলার লক্ষ্য নিয়েছে আরএসএস। গত কয়েক বছরে আরএসএসে যোগ দেওয়ার যে উৎসাহ দেখা দিয়েছে, মোদী সরকার আচমকা বিদায় নিলে তাতে ভাটা পড়তে পারে। তা ছাড়া রামমন্দির তৈরির মতো ‘রাষ্ট্রনির্মাণ’-এর বেশ কিছু কাজ হলেও এখনও অনেক কাজ বাকি বলে সঙ্ঘ পরিবারের মত।
কিন্তু এ বার যে ভোট নিয়ে তেমন উৎসাহই নেই লোকের মনে! নরেন্দ্র মোদীর পক্ষেও তেমন হাওয়া নেই মনে হচ্ছে! কথাটা মানলেন আরএসএসের প্রবীণ প্রচারক। “২০১৪-র ভোট ছিল ইউপিএ সরকারের প্রতি বিতৃষ্ণার ভোট। ২০১৯-এর নির্বাচন ছিল নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রতি প্রবল জনসমর্থন ও আস্থা প্রকাশের ভোট। এ বারের ভোট হল নিষ্ক্রিয় ভোট। সরকারের প্রতি প্রবল জনসমর্থনও নেই, আবার বিতৃষ্ণা জন্মেছে, এমনও নয়। সেই কারণে ভোটের হারও কম।”
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত নিজে ১০০ শতাংশ ভোটদানের কথা বলেছিলেন। তার সুফলও পেয়েছিল বিজেপি। এ বার কি আরএসএস ভোটদানে উৎসাহিত করছে না? আরএসএস প্রচারক উত্তর দিলেন, “প্রথম দু’দফায় আমরা তেমন সক্রিয় হইনি। তবে তৃতীয় দফা থেকে আরএসএস ভোটদানের হার বাড়াতে সক্রিয় হয়েছে। চতুর্থ দফার ভোট থেকে তার ফল দেখা যাচ্ছে।”
দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণের ঠিক আগে গত ১৯ এপ্রিল নরেন্দ্র মোদী প্রচারের ফাঁকে নাগপুরে রাত কাটিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সেটাই ছিল আরএসএসের সদর দফতরে তাঁর প্রথম রাত্রিবাস। সেখানে মোদীর সঙ্গে সঙ্ঘের নেতাদের কথা হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। তবে নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে, গোটা দেশ, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে চতুর্থ দফার ভোটগ্রহণ থেকে ভোটের হার সামান্য বাড়তে শুরু করেছে। একমাত্র চতুর্থ দফাতেই এ বারের ভোটে ২০১৯-এর থেকে বেশি ভোট পড়েছে। বিদায়ের আগে আরএসএস প্রচারক বলেন, “আরএসএস পঞ্চম দফাতেও ভোটের হার বাড়াতে আমজনতাকে উৎসাহিত করবে। আরএসএসের শতবর্ষে দেশে মোদী সরকারের থাকা জরুরি।”