মালা রায়। —ফাইল চিত্র।
লেক মার্কেটে রাধুবাবুর চায়ের দোকানে বাজারের থলিটা সঙ্গে করেই প্রভাতী-আড্ডা দিচ্ছিলেন এক প্রৌঢ়। তাঁর স্পষ্ট সিদ্ধান্ত, “মমতার (বন্দ্যোপাধ্যায়) এলাকা। ওদেরই পাল্লা ভারী।” আড্ডার বেশির ভাগ শাগরেদ সম্মতি জানালেও, এক জন অল্প রহস্য রাখলেন, “দেখা যাক।” অভিনেতা, নাট্যকার উৎপল দত্তের লব্জ ধার করে বলতে হয়, ভোট-মরসুমে এই হল ‘চায়ের ধোঁয়া’য় আলোচনা! তাতে মিশে রয়েছে কলকাতা দক্ষিণের তিন কন্যার লড়াইও। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মালা রায় যখন জয়ের ব্যবধান বাড়ানোর অঙ্ক কষছেন, তখন বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরীর হুঙ্কার, “অসম্ভবকে সম্ভব করব”। ‘মালা বদল’ হবে, আশাবাদী বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের পুত্রবধূ, সিপিএম প্রার্থী সায়রা শাহ হালিমও।
পাঁচমিশালি পাড়ার ভবানীপুর, রাসবিহারী, তুলনায় সংখ্যালঘু-প্রধান কলকাতা বন্দর, উচ্চবিত্ত প্রধান বালিগঞ্জ, মূলত মধ্যবিত্তের বেহালা পূর্ব ও পশ্চিম এবং কসবা— এই হল কলকাতা দক্ষিণ। উচ্চবিত্তের বৈভব-ব্যবসা, চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের অল্প চাওয়া-পাওয়া আর প্রান্তিক মানুষের প্রতিদিনের লড়াইয়ে এখানকার মহানাগরিক জীবনে দোলা লাগে। লগ্ন থাকে নজরকাড়া ইতিহাসও। এই কেন্দ্রের নাম একদা অন্য থাকলেও এখান থেকেই জিতেছিলেন জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এখান থেকেই সংসদে গিয়েছেন বামফ্রন্টের ‘অপারেশন বর্গা’র আইনি লড়াইয়ের অন্যতম সেনানী সাধন গুপ্ত, অর্থনীতিবিদ সিপিএমের বিপ্লব দাশগুপ্ত, কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এবং অবশ্যই ছ’বার জেতা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূল নেত্রীর সূত্রে আক্ষরিক অর্থেই এটি ‘মমতার কেন্দ্র’। এই পরিচিতির ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই প্রতাপাদিত্য রোডে নিজের দফতরে ছেলে নির্বাণকে পাশে বসিয়ে বিদায়ী সাংসদ মালা বলছেন, “এলাকার ৫৯টি ওয়ার্ড ঘুরে মনে হয়েছে, এই বারে জয়ের ব্যবধান আরও বাড়বে।” সে জন্য দলের ‘ওয়ার্ড-শক্তিতেই’ ভরসা রাখছেন সত্তরের দশক থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, বিদ্যাসাগর মহিলা কলেজের প্রাক্তনী মালা। তৃণমূলের দক্ষিণ কলকাতা জেলা সভাপতি দেবাশিস কুমারও জানাচ্ছেন, গত বারের লোকসভা ভোটে পিছিয়ে থাকা ২৬টি ওয়ার্ডে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, ১৮টি ওয়ার্ডে রয়েছে বড় ‘লিডের’ লক্ষ্যমাত্রা। এই সূত্রেই পিকনিক গার্ডেন থেকে নিউ আলিপুর, বন্দর-সহ নানা এলাকায় সুব্রত বক্সী, ফিরহাদ হাকিম-সহ তাবড় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে পৌঁছতে চেয়েছেন মালা।
মালার প্রচারে বার বার উঠে আসছে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-সহ রাজ্যের নানা প্রকল্পের কথা। প্রায় ৪৯% মহিলা ভোটারদের বড় অংশই এই প্রকল্পের উপভোক্তা, দাবি তৃণমূলের। দেবাশিস জানাচ্ছেন, তাঁদের লক্ষ্য আড়াই লক্ষ ভোটে জয়। ২০১৯-এর ভোটে মালা জিতেছিলেন এক লক্ষ ৫৫ হাজার ১৯২ ভোটে। আর ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের নিরিখে এই লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল এগিয়ে তিন লক্ষ ৪৫ হাজার ৯৮০ ভোটে। এর নেপথ্যে অবশ্যই কাজ করেছিল সংখ্যালঘু-ভোট, যা ২৭%-এরও বেশি। মালার দাবি, “সব স্তরের মানুষ, সংখ্যালঘুরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বিশ্বাস করেন।”
অথচ বন্দর এলাকারই চটকল মাঠ লাগোয়া জটলার এক তরুণ বললেন, “সবাই তৃণমূল। কিন্তু কেউ-কেউ বলছেন, জোড়াফুলেই ভোটটা দেবে তো!” — এমন ‘সংশয়’ এবং ওবিসি শংসাপত্র নিয়ে হাই কোর্টের রায়কে সামনে রেখে বিজেপির দেবশ্রী দাবি করছেন, “সংখ্যালঘু মানুষ বুঝেছেন, তৃণমূল তাঁদের ভোট-ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করে প্রতারণা করেছে।” গত বারের লোকসভা ভোটে ভবানীপুরে তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছিল বিজেপি। আর রাসবিহারীতে ৫৪২১ ভোটে এগিয়েছিল তারা।
ভবানীপুরেরই এক তরুণী বললেন, “এটা দেশের ভোট। আমরা এখন নিরাপদ।” এমন মনোভাব দেবশ্রীর হাসি চওড়া করলেও তাঁর উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের বিদায়ী সাংসদের কলকাতায় এসে প্রার্থী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। যদিও বিজেপি প্রার্থী বলছিলেন, “এখানে সেধে এসেছি। আট বছর কলকাতায় সাংগঠনিক কাজ করেছি। রায়গঞ্জে আমাকে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির গড় ভেঙে দিয়েছি! এখানেও অসম্ভবকে সম্ভব করব!”
রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প, এই আপ্তবাক্য মেনেই বিজেপি প্রার্থীর প্রচারে বার বার আসছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়ন ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। তাঁর সমর্থনে কর্মসূচি করতে দেখা গিয়েছে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা থেকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনদেরও।
‘দুর্নীতির’ প্রসঙ্গ উঠতেই বেহালা ৩এ বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এলাকার মধ্যবয়সি এক জনের বক্তব্য, “পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতার, নিয়োগ-দুর্নীতি অবশ্যই ভোটে প্রভাব ফেলবে।” দুর্নীতি আর সংবিধান রক্ষার ডাক দিয়ে বিজেপি, তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহের ভাইঝি, সেনা-কর্তা জ়ামিরউদ্দিন শাহের কন্যা সায়রা। বাড়ি-বাড়ি প্রচারে বেরিয়ে তাঁর দাবি, “মানুষ পরিবর্তন চাইছেন। নতুন ও মধ্যবিত্ত ভোটারেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
এই কেন্দ্রে গত বার বাম ও কংগ্রেসের ভোট ছিল যথাক্রমে ১১.৮০% ও ৩.৬০%। সিপিএম সূত্রে দাবি, তপসিয়া, বন্দর, বালিগঞ্জের এমন কিছু জায়গায় তাঁরা এ বার প্রচার করতে পেরেছেন, যা সাম্প্রতিক অতীতের ভোটগুলিতে করা যায়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ার ফলে সাংগঠনিক খামতিও অনেকটা কাটানো গিয়েছে। তাঁদের আশা, অন্তত ১০-১২টি ওয়ার্ডে অতীতের চেয়ে ভাল ফল হতে পারে।
সিপিএমকে অক্সিজেন দিয়েছে বালিগঞ্জ উপনির্বাচনও। সেখানে তুলনায় সংখ্যালঘু-প্রধান ৬৪ ও ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রথম এবং পাঁচটি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় হয়েছিলেন অজমেঢ়ের সোফিয়া কলেজের প্রাক্তনী সায়রা। তাঁর প্রচারে নজরকাড়া ভিড়ও হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি কলকাতা দক্ষিণের মতো তৃণমূলের গড়ে কোনও প্রভাব পড়বে? সায়রার সমর্থনে প্রচারে এসে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু অবশ্য বলে গিয়েছেন, ‘‘গড় বলে কিছু হয় না! মানুষকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করতে হয়।’’
এমন আবহেই এক নাগরিকের উক্তি, “ভোট নিয়ে কিছু বলব না!”— গণতন্ত্রে এমন মৌনী ‘ফেরারী ফৌজ’-ই বোধহয় নির্ধারক। শব্দটাকে চিনিয়েছিলেন এই কেন্দ্রেরই
হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের এক বাসিন্দা, প্রেমেন্দ্র মিত্র!