প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
যতটুকু চেয়ার পাতা, লোক রয়েছে। কিন্তু তার পিছনে মাঠ ফাঁকা। অবস্থা এমন, যে দেখে মনেই হয় না রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের সভা! খড়্গপুর শহরের ধ্যানসিংহ ময়দানের সেই সভায় রেলমন্ত্রী এলেনও নির্ধারিত সময়ের অনেকটাই পরে। জগন্নাথ মন্দির ঘুরে। সভা ফেলে রেখে মন্দিরে কেন? ভিড়ের মধ্যে থেকেই এক জন বললেন, “সভা তো এখনও ভরেইনি।” শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই সভা শেষও হয়ে গেল মিনিট কুড়ির মধ্যেই, রেলমন্ত্রী আর বিজেপি প্রার্থী দু’-একটা কথা বলার পরেই!
একে রেল-শহর, তার উপরে এই খড়্গপুর সদর কেন্দ্র, যেখানে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটা উপ-নির্বাচন বাদ দিলে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনেই জয়ী হয়েছে বিজেপি, সেখানে বিজেপি সরকারের এক জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সভা এত কম সময়েই শেষ হয়ে গেল কেন? এক কালে সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রকে হারানো বর্তমানে তৃণমূল প্রার্থী জুন মালিয়ার মনোনয়নপত্রের অন্যতম প্রস্তাবক প্রদ্যোৎ ঘোষ বললেন, “রেলমন্ত্রীর আর দোষ কী? পুরোটাই ঘেঁটে রেখেছেন দিলীপ ঘোষ আর বিজেপি!” কী ভাবে? তাঁর কথায়, “দিলীপবাবু এমন কাণ্ডকারখানা করে রেখেছিলেন যে, তাঁকে সরাতে বাধ্য হল বিজেপি। এ দিকে বিজেপির এখানকার জেলার মাথারা সবই প্রায় দিলীপবাবুর লোক। তাঁকে সরানোয় তাঁদের এমন গোঁসা হয়েছে যে, অনেকেই ভোটের কাজে নামছেন না!”
কিন্তু এমন অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা তো তৃণমূলেও রয়েছে। মেদিনীপুরের হওয়ায় কান পাতলেই শোনা যায়, তৃণমূল প্রার্থী জুনের সঙ্গে দলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরার শীতল সম্পর্কের কাহিনি। যা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও অজানা নয়। গত মার্চ মাসে মেদিনীপুরে দলীয় বৈঠকে সুজয়কে মমতা নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তুমি জুনের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবে।’ আর জুনকে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি সুজয়কে মিষ্টি খাইয়ে দিও!’ কিন্তু প্রকাশ্যে তেতো গেলার চেষ্টা হলেও এই সম্পর্কে যে মিষ্টতা আসেনি, তা অস্বীকার করেন না জেলার কোনও তৃণমূল নেতাই।
শোনা যায়, মেদিনীপুরে পুরপ্রধান সৌমেন খানের সঙ্গে ‘বিরোধ’ রয়েছে তৃণমূলের শহর সভাপতি বিশ্বনাথ পাণ্ডবের। জুনের অনুগামী সৌমেন। বিশ্বনাথের পরিচিতি সুজয়ের অনুগামী হিসাবে। ভোট-যুদ্ধের প্রস্তুতিতে তৃণমূলের নির্বাচনী কমিটি হয়েছে মেদিনীপুর শহরে। সেই কমিটিরও মাথায় (আহ্বায়ক হিসেবে) রাখা হয়নি বিশ্বনাথকে। বদলে পুর-প্রতিনিধি তথা পুর-পারিষদ সৌরভ বসুকে প্রধান করা হয়েছে। তিনি আবার জুনের অনুগামী। এই কাটাছেঁড়ার হিসাবে বিপক্ষের লাভ হয়ে যাবে না তো? অন্তর্ঘাতের ঘটনা ঘটবে না তো? হঠাৎ পরিচয়েই এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিরক্ত জুন সামলে নিয়ে বললেন, “মহিলারা লক্ষ্মীর ভান্ডার পেয়েছেন। কৃষকেরা কৃষকবন্ধুর টাকা পাচ্ছেন। দিকে দিকে উন্নয়ন। কে কাকে ছুরি মারার চেষ্টা করছে, সেই দিয়ে ভোট হবে না। দিদির নামেই মানুষ তৃণমূলকে জিতিয়ে আনবে।”
যেখানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল, সেখানকার ‘রোড শো’-এ জুনের আসার কথা ছিল বিকেল সাড়ে ৫টায়। কিন্তু তিনি পৌঁছন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টারও পরে। ভিড় তত ক্ষণে পাতলা হতে শুরু করেছে। বাড়ির কাজ ফেলে এসেছেন, জানিয়ে নেতাদের থেকে ছুটি নিয়ে তখন বেরিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক মহিলা। গাড়ি থেকে নেমে বিবেকানন্দের মূর্তিতে মালা পরিয়ে জুন অবশ্য বললেন, “ভিড়ে কিছুই বিচার হয় না। তা ছাড়া পরীক্ষায় পাশ করা প্রার্থীকে সরিয়ে দিয়ে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে, এখানে ওরা হারতই।”
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের অর্ন্তগত এগরা, দাঁতন, কেশিয়াড়ি, খড়্গপুর সদর, নারায়ণগড়, খড়্গপুর এবং মেদিনীপুর— সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে খড়্গপুর ছাড়া বাকি সব ক’টিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। ৮৮,৯৫২ ভোটে জয়ী হন বিজেপি প্রার্থী দিলীপ। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেই দেখা যায় উল্টো চিত্র। খড়্গপুর সদর ছাড়া বাকি সব ক’টি কেন্দ্রেই হেরে যায় বিজেপি। মেদিনীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ২৪,৩৯৭ ভোটে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী জুন। এর পরে বিধায়ক জুনকেই লোকসভা আসনে প্রার্থী করে তৃণমূল। অন্য দিকে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে ‘অব্যাহতি’ পাওয়ার পরে মেদিনীপুরেই ‘পড়ে ছিলেন’ ভূমিপুত্র দিলীপ। কিন্তু দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরে দেখা যায়, অগ্নিমিত্রা পালকে মেদিনীপুরে প্রার্থী করেছে বিজেপি। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ দিলীপের প্রতিবেশী নিমাই সাঁতরা বললেন, “চাষার ব্যাটা মেপে কথা বলতে পারে না। মহিলা প্রার্থীর বিরুদ্ধে কী বলে বসবে, এই ভেবে তাঁকে দল সরিয়েছে। এটা অন্যায়।” তাঁর কথায়, “আমরা প্রথম থেকে বিজেপি করি। এ বার আমরাও জুনকে ভোট দেব। আমাদের প্রতিবাদ।” পাশাপাশি দুর্গাপুর-বর্ধমান কেন্দ্র থেকে দিলীপের জয়ও চান তিনি। আর মেদিনীপুরে? বলেন, “এখানে জুন জিতুক। তা হলেই প্রমাণ হবে শুধু মেদিনীপুর নয়, গোটা বিজেপির জন্যই দিলীপ অপরিহার্য।”
সিপিআই প্রার্থী বিল্পব ভট্ট অবশ্য এ সবের মধ্যেই বলছেন, “বিজেপি, তৃণমূল— দু’পক্ষই অন্তর্ঘাতের আশঙ্কায় ভুগছে। উল্টো দিকে বামেদের ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হচ্ছে। এটুকু বলতে পারি, এ বার মেদিনীপুরের ফল হবে অভিনব।”
গত কয়েক দিনে মেদিনীপুর জেলার গ্রাম-কে-গ্রাম চষে ফেলা বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা কেশিয়াড়ির জনজাতি প্রধান এলাকায় প্রচারের মধ্যেই বললেন, “দিলীপদার মাধ্যমে বিজেপি কী কাজ করেছে, মানুষ দেখেছেন। বাকি থাকা কাজ আমার মাধ্যমে পূরণ করার সিদ্ধান্ত মানুষ নিয়ে ফেলেছেন।”
আকাশ জুড়ে তখন প্রবল কালো মেঘ। বৃষ্টি এল বলে। তড়িৎ গতিতে সাইকেল ছুটিয়ে ‘দিদিভাই’ বলে চিৎকার করতে করতে এক তরুণ এগিয়ে এসে অগ্নিমিত্রার হাতে ধরিয়ে দিলেন ছাতা। মনে পড়ে যায়, প্রচারের শুরুতেই অগ্নিমিত্রা বলে দিয়েছিলেন, তাঁকে দিদিভাই বলে ডাকতে। যার পাল্টা জুন আবার বলেছিলেন, তিনি মেদিনীপুরের মানুষের ছোড়দি হতে চান।
তীব্র ধারাপাতের মধ্যে চায়ের কাপের ধোঁয়ার মতো প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে থাকে, এই আপন হওয়ার চেষ্টায় অন্তর্ঘাতের রক্তক্ষরণ আটকানো যাবে তো?