—প্রতীকী ছবি।
ভিটেয় ঘুঘু চরছে। সোঁ সোঁ শব্দে বয়ে যাওয়া গরম বাতাসে শিল্পের সে তালুকে উড়ে বেড়াচ্ছে সাপের খোলস, ঠোঙা, খড়কুটো। চার দিক শুনশান ভরদুপুরে। এই ভিটে কর্ম-সংস্থানের, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেকারত্ব ঘোচানোর ঠিকানা দ্বারিকা শিল্পতালুক।
ভোট এসেছে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে। ২৫ মে ভোটদান হবে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের বাতাস তেতে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলির একে অন্যের বিরুদ্ধে তপ্ত বাক্যে। লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রতিযোগী হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে মাসিক তিন হাজার টাকার অন্নপূর্ণা যোজনা প্রকল্পকে। চলছে ইডি-সিবিআইয়ের জুজু প্রদর্শন। কিন্তু উঠে আসছে না বিষ্ণপুরের দ্বারিকা শিল্পতালুককে চাঙ্গা করার পরিকল্পনার কথা। একটি বন্ধ কারখানা টাটা গোষ্ঠী অধিগ্রহণ করেছে, আপাতত আশার ক্ষীণ আলো সেটাই।
অথচ, এক সময়ে ফেরো অ্যালয়ের কারখানায় সমৃদ্ধ দ্বারিকা শিল্পতালুক বিষ্ণুপুরের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর তো বটেই, অন্য রাজ্য থেকেও সেখানে লোকজন কাজ করতে আসতেন। কিন্তু গত প্রায় এক দশক ধরে সেই শিল্পতালুকে যেন মৃত জনে প্রাণের সন্ধান করতে হচ্ছে।
কিন্তু সে প্রাণ দেবে কে? আর প্রাণের দাবিই বা করবেন কারা?
লোকসভা কেন্দ্র বেশি মজে রয়েছে প্রধান দুই দল তৃণমূল ও বিজেপির দুই প্রার্থীর চর্চায়। বর্তমান বিজেপি সাংসদ তথা এ বারের প্রার্থী সৌমিত্র খাঁয়ের সঙ্গে তৃণমূলের প্রার্থী সুজাতা মণ্ডলের সংসার ভাঙার গল্প বেকারত্ব, জলকষ্ট, বালুচরী-তাঁতিদের দুরবস্থা, শিল্পাঞ্চলের মুমূর্ষু পরিস্থিতি কিংবা যদু ভট্টের শহরে এশিয়ার সব চেয়ে প্রাচীন সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় বিষ্ণুপুর রামশরণ মিউজ়িক কলেজের সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়ার মতো বিষ্ণুপুরের নিজস্ব চাহিদাগুলিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সময়ে সৌমিত্র-সুজাতা দম্পতি। আইনি জটিলতায় সৌমিত্র সে বার বিষ্ণুপুর এলাকায় ঢুকতেই পারেননি ভোটের আগে। স্বামীর ছবি আর নরেন্দ্র মোদীর মুখকে সামনে রেখে এলাকা চষে ফেলেছিলেন সুজাতা, তৃণমূলকে তুলোধোনা করেছিলেনও সর্বত্র। শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুপুরে পদ্ম ফোটে। এর বছর দুয়েকের মধ্যেই দম্পতির দুই পথ দুই দিকে বেঁকে যায়। সৌমিত্রের ‘ঘর’ থেকে সুজাতাকে বার করে কলকাতার তপসিয়ায় নিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেয় তৃণমূল। এখন তাঁরা একে অন্যের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রথম পরীক্ষায় ২০২১ সালে আরামবাগ বিধানসভা থেকে তৃণমূলের টিকিট পেয়েও হেরে যান সুজাতা। বর্তমানে বাঁকুড়া জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ তিনি। তবে কেন্দ্রের খবর, এ বারে ‘প্রাক্তনের’ হাত থেকে কেন্দ্র পুনরুদ্ধারের গুরুভার সুজাতার উপরে। হয় তিনি ইন্দ্রপতন ঘটাবেন, না হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইয়ের পাশাপাশি সুজাতা তাই নিজের প্রচারে সৌমিত্রের বিরুদ্ধে কখনও কখনও চোখা চোখা সংলাপ ব্যবহার করছেন। ভ্যাপসা গরমে জয়পুরে দলীয় কার্যালয়ে বসে সুজাতার বক্তব্য, “সে বার স্ত্রীর কর্তব্য করেছিলাম। এ বার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি। তবে ওই সময় থেকে বিষ্ণুপুরের রাজনীতির জমিটা আমি চিনে ফেলেছি, চষে ফেলেছি। মমতাদি ওঁকে প্রথম সাংসদ করেছিলেন। উনি বিষ্ণুপুরের জন্য কিছুই করেননি। শুধু বিলাসবহুল জীবন কাটিয়েছেন। আমি মানুষের কাছে গিয়ে আমার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি।” এলাকার উন্নয়ন থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রসঙ্গ তুলে তাঁর সংযোজন, “এ বার এখানে মমতাদির জয় অনিবার্য।”
ছাড়ার পাত্র নন সৌমিত্রও। ঠিক ছিল বিষ্ণুপুর শহরে কলেজ রোডে দলের প্রধান কার্যালয়ে বসে কথা হবে। ইতিহাস বলছে, সেই বাড়িটিতেই এক সময়ে দ্বারিকা শিল্পতালুকের কর্মীরা ভাড়া থাকতেন। পরে সেটি বিজেপি কিনে নেয়। সৌমিত্র অবশ্য তাঁর ফ্ল্যাটে বসে কথা বললেন। ২০১৯ সালের ভোটে তাঁর হয়ে সুজাতার প্রচারে নামাকে গুরুত্বই দিতে চান না নতুন সংসার পাতা সৌমিত্র। তাঁর কথায়, “সেই সময়ে মোদীর সুনামি চলছিল। দিন পনেরো প্রচারে নামলেই কি নেত্রী হওয়া যায় নাকি! ওঁর সঙ্গে তিন হাজার কর্মী নেমেছিলেন। মানুষ সৌমিত্র খাঁর সততা দেখে ভোট দিয়েছিলেন।”
তৃণমূল প্রার্থী যে বলছেন, কিছুই করেননি আপনি? সৌমিত্রের কথায়, “ওঁর চৈতন্য হোক। এ বার দেড় লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জিতব। কাজ না করলে মানুষ ভোট দেবেন কেন?” ‘প্রাক্তনের’ প্রতি সৌমিত্রের পাল্টা তির, “ওঁর রাজনৈতিক জীবন অনিশ্চয়তার মুখে।” দিলেন কাজের তালিকা: ২২০ কোটি টাকার প্রকল্পে বিষ্ণুপুর-জয়রামবাটি রেলপথের কাজ শুরু করিয়েছেন যা শেষ করতে চান, মোড়গ্রাম হয়ে সিউড়ি পর্যন্ত নতুন জাতীয় সড়ক তৈরি। বিষ্ণুপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অধিগৃহীত জমিতে প্রকল্প তৈরি বা বালুচরী-স্বর্ণচরী শাড়ি শিল্পে বিনিয়োগকারীর সন্ধানের মতো নানা পরিকল্পনার কথাও শোনান।
কেন্দ্রের খবর, দু’পক্ষই একে অন্যকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে প্রচারে। সুজাতা ক্রিকেট ব্যাট হাতে মানুষের মাঝে গেলে, সৌমিত্রের দেখা মিলছে ফুটবল মাঠে। তাই এ বার বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে ফলাফল স্বল্প ব্যবধানে হতে পারে বলেই মনে করছেন অনেকে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের হিসাবে বিষ্ণুপুর কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে পাঁচটিতে বিজেপি জিতেছে। তবে বিষ্ণুপুর ও কোতুলপুরের দুই বিজেপি বিধায়ক আবার তৃণমূলে চলে এসেছেন। যদিও বিজেপির দাবি, ওই দুই নেতা গেলেও কর্মীরা কেউ যাননি।
দুই প্রধান দলের দড়ি টানাটানির মধ্যে বামেরা জানাচ্ছে, তাদের সময়েই দ্বারিকা এবং বড়জোড়া শিল্পাঞ্চল তৈরি হয়েছিল। তারা মানছে, ফেরো অ্যালয় থেকে দূষণ ছড়ানোয় সেই সব কারখানা উঠে গেলেও শিল্পাঞ্চলে আধুনিক শিল্প নিয়ে আসার কোনও তাগিদ গত দশ বছরে তৃণমূল-বিজেপি কেউ দেখায়নি। সিপিএম প্রার্থী শীতল কৈবর্ত্যের কথায়, “শুধু প্রকল্প দিয়ে কী হবে? কর্মসংস্থান কোথায়? আমরা মানুষকে বলছি, ভোট দেওয়ার আগে ভাবুন কাকে ভোট দিচ্ছেন।”
তা হলে? জবাবের অপেক্ষায় বসে শুনশান দ্বারিকা শিল্পতালুক।