—প্রতীকী ছবি।
তাপমাত্রা ৪০ ছুঁইছুঁই। সরবেড়িয়া বাজার। সূর্য কিছুক্ষণের মধ্যে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়বে। প্রায় জন-মানবশূন্য হওয়ায় কোনও রকম বাধা ছাড়াই চোখে পড়ে শেখ শাহজাহানের নামাঙ্কিত বাজার। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে তাঁর দাপট কল্পনার চেষ্টা করতেই কানে আসে ভারী বুটের শব্দ। হেঁটে যাচ্ছেন আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা।
তাঁদের পেরিয়ে কিছু দূর এগোলেই পথ নির্দেশিকায় লেখা আকুঞ্জিপাড়া। আরও খানিকটা এগোলে বেড়মজুর। দিনের বেলা শান্ত। রাত বাড়লে গ্রাম উজাড় হয়ে পথে। ঝাঁটা হাতে শঙ্খে ফুঁ দেন মহিলারা। চলে রাত পাহারা। সময়ের গতিতে ফিকে হয়ে যায় রং। তবু দেওয়াল লিখনে উপস্থিতি জানান দেন শাহজাহান। ধামাখালি থেকে ছোট কলাগাছি নদী পেরিয়ে সন্দেশখালি। ভোট মরসুমে যে নাম আলাদা করে দাগ কেটে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মাটি কী বলছে?
কাঁচা-পাকা মেশানো বাড়ি। সামনের এক ছটাক জমিতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কাজ করছেন। তাঁদের দেওয়ালে বড় করে লেখা বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী হাজী নুরুল ইসলামকে ভোট দেওয়ার আবেদন। সন্দেশখালির আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করতেই তাঁরা গড়গড় করে দিয়ে চলেন জুলুমের ফিরিস্তি। কিন্তু মহিলাদের উপরে অত্যাচার? কিছু ক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “এই অভিযোগ না উঠলে শাহজাহানকে আজও কেউ গ্রেফতার করতে পারত না। আমরা তো এখনও ভয়ে আছি। ওরা ছাড়া পেলে অত্যাচার আরও বাড়িয়ে দেবে।” কিছুটা দূরত্বে এক ব্যক্তি স্নান করে যাচ্ছিলেন অনেক ক্ষণ ধরেই। মুখ খোলার সুযোগ পেয়েই সতর্ক করে দিলেন, “আগে দলটা করতো। আবাস যোজনার বাড়ি পেয়েছে। এখন গলায় উল্টো সুর। সব কথা বিশ্বাস করবেন না!”
আরও কিছুটা এগোতেই দরমার বেড়া দেওয়া মাটির দু’ফালি ঘর। ঘরের কর্ত্রী আন্দোলনের অন্যতম মুখ। প্রথমে বেশ খানিক ক্ষণ গুম মেরে ছিলেন। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললেন, “এখন সময়ে-অসময়ে গ্রামে পুলিশ ঢুকছে। মিথ্যে কেস দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাই কাউকেই আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।” প্রসঙ্গ উঠল গঙ্গাধরের। রাগত স্বরে বললেন, “কে তিনি? আমি চিনি না। আন্দোলনের সময় তো এরা কেউ ছিলেন না। এখন কোথা থেকে এঁরা এসে আন্দোলনকে বদনাম করার চেষ্টা করছেন!”
এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ রেখা পাত্র বসিরহাট লোকসভায় বিজেপির প্রার্থী। বসিরহাট উত্তরের ঘড়িবাড়ি এলাকার একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন নির্বাচন উপলক্ষে। তিন ধাপ পরীক্ষা দিয়ে সেই বাড়ির এক তলায় বসার জায়গা হল। রেখা নামতেই প্রশ্ন করে বসলেন, “আপনি কে? এখানে কী চাই? কে খবর দিল আমি এখানে আছি?” বোঝা গেল ‘স্টিং-এর ব্যথা এখনও রয়ে গিয়েছে। সঙ্গীরা জানালেন, কথা বলা ‘উপর’ থেকে বারণ আছে। তাতেও নাছোড় ভাব দেখাতে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন তাঁর স্বামী। প্রায় ‘অর্ধচন্দ্র’ দিতে দিতে বললেন, “আমি ওঁর স্বামী। আমার অনুমতির কোনও দাম নেই? আমি তো বলছি, ও কথা বলবে না।” বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ দিনের পোড় খাওয়া এক বিজেপি নেতার অনুশোচনা, “অরাজনৈতিক প্রার্থী দিলে কী হয়, আমরা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি!”
বসিরহাটের প্রার্থীর সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভা ভেঙেছে কিছু ক্ষণ আগে। ফিরতি পথে দেখা মিলল সন্দেশখালির তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক সুকুমার মাহাতোর। বললেন, “কিছু ভুল তো ছিল। তবে তার প্রভাব পাঁচ-ছ’টা বুথের বাইরে নয়। সন্দেশখালি নামটা নিয়ে যতটা প্রচার হল, গোটা সন্দেশখালিতে তার কোনও প্রভাব নেই। ন্যাজাট আর মণিপুরটা নিয়ে চিন্তা আছে। ওটাও ঠিক হয়ে যাবে।”
গত তিনটি লোকসভায় বসিরহাট আসন তৃণমূল নিজেদের গড়ে পরিণত করেছে। বিজেপিও বেড়েছে বেশ খানিকটা। গত নির্বাচনে মাত্র ৬৮ হাজার ভোট পেয়ে বামেরা প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে এ বারের পরিস্থিতি দৃশ্যতই আলাদা। রাজনৈতিক লড়াইকে উপরি কাঠামোয় রেখে অন্দরে জায়গা করে নিয়েছে ধর্মীয় মেরুকরণ।
মুখ্যমন্ত্রীর জনসভা উপলক্ষে টাকি রোড স্টেশনের টোটো স্ট্যান্ডের প্রত্যেক টোটোয় তৃণমূলের পতাকা বাঁধা হচ্ছিল। হাতের কাজ শেষ হতে টোটোওয়ালাকে ভোট নিয়ে প্রশ্ন করতেই তাঁর উত্তর, “আমরা তো হিন্দু। হিন্দুকেই ভোট দেব। আমাদের হাতে তৃণমূল। বুকে পদ্মফুল!”
মিনাখাঁ, হাড়োয়া, বাদুড়িয়া— এই তিন বিধানসভা কেন্দ্রের সিংহ ভাগ অংশে অবশ্য বিজেপির কোনও পতাকাই নেই। বদলে উঁকি দিচ্ছে নীল, সাদা সবুজের মাঝে এক খানা খাম। হাড়োয়ায় মূল লড়াই যেন তৃণমূল বনাম আইএসএফ। হাড়োয়া বাজারে এক দল যুবক জটলা করেছিলেন। তাঁদের কাছে ভোটের আবহাওয়া জানতে চাইতে তাঁরা বললেন, “এখানে শুধুই তৃণমূল।” বাদুড়িয়ায় ঢুকতেই আবার ছবির বদল! এখানে লাল পতাকার আধিক্য। বাদুড়িয়া বাজার ছেড়ে কিছুটা ভেতরে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন বেশ কয়েক জন। তাঁদের এক জনের মতে, ‘‘সিপিএম ভাল ভোট পাবে। আইএসএফ-ও পাবে বেশ কিছু। তবে ওরা কার ভোট কাটবে, সেটাই দেখার।” যদিও আইএসএফ প্রার্থী আক্তার রহমান বিশ্বাসের দাবি, “আমরা ভোট-কাটুয়া নই। জেতার জন্যই লড়ছি।”
বিজেপির বৈঠকে ছিলেন বসিরহাট সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তাপস ঘোষ। তাঁর দাবি, “হিঙ্গলগঞ্জ, বসিরহাট দক্ষিণ, সন্দেশখালি, বাদুড়িয়ায় আমরা জিতব।”
এই সব কিছুর থেকে অনেকটা দূরে নিবিড় প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন সিপিএম প্রার্থী নিরাপদ সর্দার। বাম শরিক সিপিআইয়ের কাছ থেকে নিয়ে বহু বছর পরে বসিরহাট আসনে লড়ছে সিপিএম। বেলিয়াঘাটা থেকে প্রচার সেরে ফেরার পথে সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ বললেন, “ফল নিয়ে ভাবছি না। পঞ্চায়েত ভোটের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করছি। জমানা বদলের পর এই প্রথম ৭টা বিধানসভাতেই ঢুকেছি। ভোট ঠিক মতো হলে বাদুড়িয়া, বসিরহাট উত্তরে এগিয়ে থাকব। মিলিয়ে নেবেন!”