(বাঁ দিকে) জগন্মোহন রেড্ডি এবং ওয়াইএস শর্মিলা। — ফাইল চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী জগন রেড্ডির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, স্ত্রী ভারতী না বোন শর্মিলা —সেই প্রশ্নে আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে পড়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাজশেখর রেড্ডির পরিবার। পুত্র জগন যখন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রিত্বের কুর্সি এবং লোকসভায় এক ডজনের বেশি আসন জিতে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে চাইছেন, তখন তা ভণ্ডুল করতে নেমে পড়েছেন বোন শর্মিলা। ভোটের ঠিক আগে আদর্শের কথা তুলে শর্মিলা কংগ্রেসে যোগ দিলেও, বিরোধীরা বলছেন, এ সবই হল আসলে রাজশেখর রেড্ডির সম্পত্তি ভাগ নিয়ে বিবাদ। বোন ভাগ চেয়েছে, তাতে আপত্তি জানিয়েছেন বৌদি। তা নিয়েই যাবতীয় ঝামেলা। যে গন্ডগোল এখন পরিবারের সীমানা ছাড়িয়ে রাজনৈতিক বিবাদে পরিণত হয়েছে।
ভাইয়ের মনোভাবে ক্ষুব্ধ শর্মিলা ভোটের আগে (ওড়িশার মতো এ রাজ্যেও বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন এক সঙ্গে হচ্ছে) কংগ্রেসের টিকিটে লোকসভা নির্বাচন লড়ছেন কাডাপা আসনে। কাডাপা আবার জগনের খাসতালুক। এখান থেকেই বিধানসভা নির্বাচনে লড়েন জগন। এ বার কাডাপা লোকসভা কেন্দ্রে জগনের দল টিকিট দিয়েছে অবিনাশ রেড্ডিকে। যাঁর বিরুদ্ধে জগনের কাকা তথা রাজশেখর রেড্ডির ছোট ভাই প্রাক্তন মন্ত্রী বিবেকানন্দ রেড্ডিকে বিষ দিয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে।
অবিনাশকে টিকিট দেওয়ার প্রশ্নে গোড়াতেই আপত্তি জানিয়েছিলেন বিবেকানন্দের মেয়ে তথা জগনের খুড়তুতো বোন সুনীতা। আপত্তি করেছিলেন শর্মিলাও। কিন্তু কারও আপত্তি শোনেনি জগন। টিকিট দেন অবিনাশকেই। জগনের একগুঁয়েমি দেখে তাঁকে শিক্ষা দিতেই কাকার হত্যায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন শর্মিলা। সমর্থনে পাশে পেয়েছেন সুনীতাকেও। প্রচারে নেমে তাই শর্মিলা বলছেন, বোন সুনীতাকে ন্যায়বিচার দিতে প্রয়োজনে পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পিছপা নন তিনি। শর্মিলা-সুনীতা, দুই বোনের লড়াইয়ের ডাক প্রভাব ফেলেছে রাজ্যের মহিলা মহলে। কিন্তু তা জগনবিরোধিতার আকার নেয় কি না তা এখন দেখার।
বিজয়ওয়াড়ার হনুমানপেটে প্রচারে এসেছিলেন জগন। বিকেল তিনটের সভা শুরু হল পাঁচটায়। বাতাসে গরম হাওয়ার ঝলকানি। মোবাইলে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে
৪৩ ডিগ্রি। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে ভিড় জমিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও পরিবারে ভাঙন ধরিয়ে রাজশেখর রেড্ডির ঐতিহ্যকে মুছে দেওয়ার চক্রান্তের অভিযোগ জগন তুলেছেন টিডিপি নেতা চন্দ্রবাবু নায়ডু ও শর্মিলা জুটির দিকে। দিচ্ছেন শাড়ির খোঁটাও। বাম দলের যেমন লাল, বিজেপির গেরুয়া, তেমনি টিডিপি-র হলুদ। গত জানুয়ারিতে ছেলের বিয়ের আমন্ত্রণ জানাতে উজ্জ্বল হলুদ রঙের শাড়ি পরে চন্দ্রবাবু নায়ডুর বাসভবনে গিয়েছিলেন শর্মিলা। তাতেই চটেছেন জগন। শত্রু শিবিরে শত্রু দলের রঙের শাড়ি পরে গিয়ে শর্মিলা মিত্রতার হাত বাড়াতে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগে সরব জগন। তাঁর কথায়, ‘‘যারা রাজশেখরকে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মুছে দিতে চায়, তাদের বাড়িতে হলুদ শাড়ি পরে হাতজোড় করে প্রণাম করার কি দরকার ছিল?
মুখ খুলেছেন শর্মিলাও। তাঁর কথায়, ‘‘খারাপ লাগছে এক জন মুখ্যমন্ত্রী এক মহিলার শাড়ি নিয়ে টানাটানি করছেন এবং তিনি
আমার ভাই।’’
পারিবারিক বিবাদের মতোই দলের কর্মী-সমর্থক ও আমজনতার একঅংশের ক্ষোভ সামলাতে হচ্ছে জগনকে। বিজয়ওয়াড়ায় দীর্ঘ সময় ধরে ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসা সুনীল রাওয়ের। রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশ তিনি। তাঁর মতে, ‘‘রাজ্য ভাগের পরে যে কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্য পাওয়ার কথা ছিল তা পাওয়া যায়নি। রাজ্যের সামগ্রিক বিকাশে তিনটি রাজধানী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, তা ব্যর্থ হয়েছে। সে ভাবে কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে আসতে পারেননি জগন। শিল্প সংস্থা যা ছিল তাও বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আবাসন শিল্প ধসে গিয়েছে। লোকের কাজ নেই। সরকারি প্রকল্পের নামে টাকা লুট হয়েছে। জগনকে হারাতে তাই মানুষ ক্রমশ এককাট্টা হচ্ছেন।’’
জনগণের সেই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে তাই পরস্পরের হাত ধরেছেন বিজেপি, টিডিপি ও অভিনেতা পবন কল্যাণের দল জনসেনা। হনুমানপেটে জগনের সভার দায়িত্বে থাকা নরসিংহ বাবু অবশ্য এ বারের লড়াইকে ধনী ও গরিবের লড়াই হিসেসাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভ রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ বারের লড়াই শ্রেণিগত লড়াই। উচ্চবিত্তেরা নায়ডুকে চাইছেন। কিন্তু গরিব মানুষ,যাঁরা সরকারের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের লাভ পাচ্ছেন, তাঁরা আমাদের পক্ষেই রয়েছেন।’’
সমস্যা রয়েছে দলের মধ্যেও। শোনা যাচ্ছে দলের কর্মী-সমর্থকদেরও বড় অংশ মুখ ফিরিয়েছে জগনের থেকে। ভোটকুশলী রবি কুমার বললেন, ‘‘পাঁচ বছর আগে ক্ষমতায় এসে সিভিক ভলান্টিয়ারদের একটি দল গড়েছিলেন জগন। যাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুফল মানুষের ঘরে ধরে পৌঁছে দেওয়া। পাঁচ হাজার টাকা বেতনের বিনিময়ে ওই ভলান্টিয়াররা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হন। তাঁদের দাপটে উপেক্ষিত হন দলের কর্মী-সমর্থকেরা।’’ ফলে নিচুতলায় ভাঙন ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝে শেষ বেলায় ওই সিভিক ভলান্টিয়ারদের ইস্তফা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন জগন। কিন্তু ত্রিশ হাজারের মধ্যে মাত্র এক হাজার
ইস্তফা দেন। কারণ, তত দিনে ক্ষমতায় এলে তাঁদের বেতন দশ হাজার টাকা করা ও চাকরি পাকা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট ময়দানে নেমে পড়েন চন্দ্রবাবু নায়ডু।
প্রতিকূলতার মধ্যেও জগন শিবিরের আশা, গত পাঁচ বছরে সরকার গরিবদের পাশে থেকেছে, তাতে আমজনতা মোটের উপর সন্তুষ্ট। প্রবীণ ব্যক্তিদের পেনশন, পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মহিলাদের নিয়মিত অর্থসাহায্য, স্কুল পড়ুয়াদের সাইকেল থেকে শুরু করে কম্পিউটার দেওয়ার মতো ‘খয়রাতির রাজনীতি’র কৌশলে একটি বড় অংশ জগনকেই ফের ক্ষমতায় দেখতে চাইছেন বলে আশাবাদী নরসিংহেরা। তাঁদের মতে, বিরোধীরা যতই জোট করুক, প্রকল্পের উপভোক্তারা যদি জগনের পক্ষে ভোটের বাক্সে ঝড় তোলেন, খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে টিডিপি-বিজেপি-জনসেনার জোট।