নিজের চেম্বারে নির্মল সাহা — নিজস্ব চিত্র।
অনেক সংখ্যক রোগীকে ভাল পরামর্শ দেওয়া সম্ভব নয়! স্পষ্ট করে বলা বাইরের সাইন বোর্ডে। সঙ্গে আরও গুচ্ছ বিজ্ঞপ্তি। সাবেক বাড়ির এক তলার চেম্বারে আগন্তুককে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন ডাক্তারবাবু।
‘দাদা’ কী আর পারবেন? এ বারের লোকসভা ভোটে গোটা বাংলা জুড়ে সব চেয়ে চর্চিত প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতেই এই চেম্বারে ঢোকা। পিছনে জাতীয় পতাকা শোভিত চেয়ারে যিনি বসে আছেন, বহরমপুরের সুপরিচিত শল্য চিকিৎসক নির্মল কুমার সাহা। চণ্ডীগড় থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে সরকারি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ডাক্তারি করেছেন। অবসরের পরে নিজের চেম্বার। ভোটের সময়ে ফোনে ‘পরামর্শ’ পেয়ে রাস্তার উল্টো দিকে বিজেপি কার্যালয়ে গিয়ে বসতে হয়েছিল তাঁকে। কারণ, টানা ২৫ বছর কংগ্রেসের দখলে থাকা বহরমপুর আসনে এই চিকিৎসককেই প্রার্থী করেছে পদ্ম শিবির। এবং বলে রাখা যাক, ‘নিমু ডাক্তারে’র রোগীর তালিকায় বহরমপুরের ২৫ বছরের সাংসদও আছেন!
নির্মল বিশ্বাস করেন, ‘‘শুধু দূর থেকে দেখব আর সমালোচনা করব, এই করলে হবে না। রাজনীতিতে স্বচ্ছ মানুষজনের অবশ্যই আসা উচিত। তাই রাজি হয়েছি প্রার্থী হতে।’’ পারিবারিক শিকড় আরএসএসের সঙ্গে, তাই বিজেপিকে বেছে নিতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। সাংসদ হলে বহরমপুরকে আরও নির্মল, স্মার্ট সিটি বানানো-সহ পরিকাঠামো উন্নয়নে কী কী করা সম্ভব, তার লম্বা তালিকা তাঁর কাছে আছে। একই সঙ্গে স্বীকার করেন, করা সম্ভব মানেই তিনি সে সব করতে পারবেন, এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না! কারণ, বাস্তবে জট অনেক। এ সবের ফাঁকেই হেসে জিজ্ঞাসা করে নেন, ‘‘রাজনীতিকের মতো কথা বলতে শিখে যাচ্ছি তো?’’ আর ‘দাদা’র ব্যাপারে? ‘‘ওঁকে নিয়ে আমি কী বলব! উনি অভিজ্ঞ, দুঁদে রাজনীতিক। সৌজন্যমূলক সম্পর্ক আমাদের।’’
নির্মলের মতোই ভোটের আগে হঠাৎ ফোন পেয়ে ভোটের ময়দানে চলে এসেছেন আরও এক জন। ইউসুফ পাঠান! এক দিনের ক্রিকেট এবং টি-২০ বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের এককালীন সদস্য। এখন শ্রীলঙ্কায় লিগ খেলেন। সেখান থেকেই সটান এসে বহরমপুরের হোটেলে আস্তানা গেড়েছেন। সঙ্গে ‘আপেল ব্রিগেড’! যারা তাঁকে ঘিরে থাকে, সর্বক্ষণ সঙ্গে আপেল রাখে। কেকেআর-এর হয়ে আইপিএলে খেলেছেন, সেই সূত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা জানা ছিল। মুর্শিদাবাদে জনশ্রুতি, শক্ত আসনে তৃণমূলের হয়ে লড়তে আসার জন্য ‘প্যাকেজ’-এর বন্দোবস্ত হয়েছে! আর পাঠান বলেন, ‘‘ক্রিকেটের কেরিয়ার তো শেষ। অন্য কিছু করাই যায়। এই প্রস্তাবটা
পেয়ে বাড়িতে সকলের সঙ্গে আলোচনা করলাম, মনে হল ভালই হবে। ইনশা আল্লা, এত মানুষ পাশে আছেন, জিতব!’’ এর বাইরে রাজনীতির কথা তেমন নেই পাঠানের মুখে। তাঁর প্রচারে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’-এর গান ব্যবহার করে বাতাবরণ তৈরি করে চলেছে তৃণমূল। মাইক হাতে পেলে পাঠান স্কুল, ভাল স্টেডিয়াম তৈরির মতো আশ্বাস এবং পেন ধরিয়ে দিলে অটোগ্রাফ বিলি করছেন। সঙ্গে নিজস্বীও।
সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক ইনসার আলি বিশ্বাসকে পাশে নিয়ে প্রচার - সভায় অধীর চৌধুরী। — নিজস্ব চিত্র।
গ্রামে-গঞ্জে, শহরে পাঠানকে দেদার রোড-শো’য় ঘোরাচ্ছে তৃণমূল। নওদায় শাসক শিবিরে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব প্রবল, সেখানে বারেবারে পাঠান। বড়ঞার বিধায়ক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে ময়দানে নেই, সেখানে ‘ঝুমে যো পাঠান...’! গ্রামের ধুলো-কাদায় কখনও সখনও চাকা বসেও যাচ্ছে! তিন বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে আড়াই লক্ষের বেশি ব্যবধানে এগিয়ে তৃণমূল। এ বার তাদের অঙ্ক— পাঠান এসে সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসিয়ে দেবেন আর ডাক্তারবাবু হিন্দু ভোট কেটে নিয়ে যাবেন, তা হলেই কেল্লা ফতে! এই অঙ্কে ভর করেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বহরমপুরের পুর-প্রধান নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায়, সক্কলে ‘দাদা’র সমাধি-লিপি লিখে বসে আছেন!
যে ইন্দ্রপতনের আখ্যান আগাম লেখা হয়ে গেল, সেখানেই কি খেলা শেষ? কাহিনির ‘ইন্দ্র’ জেলখানার উল্টো দিকে কংগ্রেস জেলা দফতরের তিন তলার ঘরে ধীর-স্থির বসে সব শুনছেন! টানা হেরে চলা বহরমপুর আসনে সেই ১৯৯৯ সালে যখন প্রার্থী হয়েছিলেন, সেই লড়াই বেশি কঠিন ছিল? না এ বারের চাপ বেশি? বলছেন, ‘‘তখন বামেদের সঙ্গে প্রবল রাজনৈতিক লড়াই ছিল, সন্ত্রাসও ছিল। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা রাজনৈতিক ছিল। এখন নোংরামি অনেক বেশি। দু’টো পরিস্থিতি আলাদা।’’ তাঁর মতে, সংখ্যালঘু এলাকায় গিয়ে শাসক দল বলছে ‘দাদাকে এত দিন ভোট দিয়েছো, এ বার ভাইকে (ভাইজান অর্থাৎ পাঠান) দাও’। আর অন্যত্র বলছে, ‘দাদা জিতবে না, ভোট নষ্ট না করে ডাক্তারকে দাও’। এমন ভোটের জাঁতাকলে তিনি এবং বহরমপুর আগে পড়েনি!
কংগ্রেস নেতারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রামনবমীকে ঘিরে শক্তিপুরে অশান্তি বাধার পরে ‘দাদা’র হস্তক্ষেপেই কেন্দ্রীয় বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল। তার রেশ ধরেই ‘দাদা’ বলছেন, ‘‘জঙ্গিপুরে ৬৭% সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত আসনে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে জিতিয়েছি এক সময়। মুর্শিদাবাদ যোগ্য লোকের কদর জানে। আমি অধীর চৌধুরী এই মুর্শিদাবাদে, এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, সংঘর্ষ হতে দেব না। প্রয়োজনে প্রাণ দেব!’’ সঙ্গে সংযোজন, পাঁচ বারের সাংসদ তিনি। নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি কী করেছেন আর কী করতে পারেন, মানুষ বিলক্ষণ জানেন।
নিজেকে নিয়ে না হয় নতুন করে বলার নেই, বিপক্ষ প্রার্থীদের সম্পর্কে কী বলবেন? ‘‘পাঠান নামী ক্রিকেটার। গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বলেন কি না, জানা নেই! আর বহরমপুর ছোট শহর, সবাই সবাইকে চেনে। ডাক্তারবাবুর আমিও রোগী আরও অনেকের মতো। ব্যক্তির বিরুদ্ধে তো লড়াই নয়।’’
এক কালে সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করে উঠে আসা কংগ্রেস সাংসদের সঙ্গে এ বার কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে সিপিএমই। দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘উনি একাই কাফি! এই জেলার সঙ্গে একাত্ম। তবে বাম ও কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা আন্তরিক ভাবে একসঙ্গে লড়ছেন। সামাজিক ও অন্যান্য সংগঠনও এখানে নেমেছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির জন্য।’’
অভিষেক এসে তাঁকে ‘বিজেপির ডামি’ বলে গেঁথে যাওয়ার পরে প্রচারের শেষ দিনে দাদার মিছিলে থিক থিকে লোক। সেই মিছিলের রাস্তায় মুখোমুখি হয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষ ‘দাদা’র গাড়িতে ফুল ছুড়ে দিয়েছেন নির্মলও।
এত সবের পরে বহরমপুর কি ‘দাদা’রই থাকবে? না রং বদলাবে? ‘‘শেষ বল হওয়ার আগে খেলা শেষ হয় না! রাজনীতিতেও।’’ বলছেন অধীর। মনে পড়ে যাচ্ছে, ডাক্তারবাবুর চেম্বারের বাইরে টাঙানো বোর্ডে সেই ‘বিনীত আবেদন’টাও। ‘এখানে সমস্ত অসুখের ভাল চিকিৎসা করা হয় না’!