বিজেপির প্রসান্ত রায় বসুনিয়ার বাবা-মা। ছবি: সুমন মণ্ডল।
রাস্তার পাশে সাঁটা ‘খেলো ইন্ডিয়া’র পোস্টার। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের ছবির সঙ্গে পোস্টারে লেখাও রয়েছে— ‘খেলেগা ইন্ডিয়া, তভি তো জিতেগা ইন্ডিয়া’। কোচবিহারের দিনহাটায় ভেটাগুড়ি বাসস্টপে রাস্তার পাশে টাঙানো সে পোস্টার পেরোনোর সময়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রৌঢ়ের টিপ্পনী, ‘‘এখানে তো খেলা শুরুহয়ে গিয়েছে!’’
কেমন খেলা? রাত বাড়তেই বাড়ছে বোমার শব্দ। উদ্ধার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। খবর মিলছে বাড়ি-ঘর ভাঙচুরেরও। ভেটাগুড়ি তো বটেই, গোটা দিনহাটায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে এই সব আলোচনা।
ভেটাগুড়িতে নিশীথের বাড়ি। এলাকার রুইয়ের কুঠি-কাশীগাঁও ঘাটপাড়ে চায়ের দোকানে বসে ছিলেন বুদ্ধেশ্বর বর্মণ। বললেন, “ভোট এল মানেই আমাদের বড় আতঙ্ক। তা সে যে ভোটই হোক। সারাক্ষণ মনে হয়, কখন, কার যে কী হবে! তাই এ বারে ভোট ঘোষণা হতেই সন্ধ্যার পরে বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছি।” বুড়িরহাট অঞ্চলের বালাকুড়ার বাসিন্দা আশিয়ার রহমান গত পাঁচ বছর ধরে টোটো চালান। তাঁর বক্তব্য, “নেতায়-নেতায় যুদ্ধে উলুখাগড়া হতে চাই না। তাই এখন সন্ধ্যার পরে টোটো চালানো বন্ধ।”
কারা করে সন্ত্রাস? এলাকায় ঘুরে জানা গেল, দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের দিকে অভিযোগের আঙুল তো উঠছেই, এলাকায় যাতায়াত রয়েছে ‘বহিরাগতদের’ও। জেলা কোচবিহারে বাংলাদেশ সীমান্তের অনেকটা অংশে কাঁটাতার নেই। দিনহাটার শালমারা থেকে দিঘলটারি হয়ে ছোট গারোলঝরা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতার নেই। কাঁটাতার বিহীন এলাকা রয়েছে গীতালদহ এবং সিতাইয়ের একাংশেও। এলাকাবাসীর দাবি, খোলা সীমান্ত-পথে ‘গরু পাচার’ বহু দিনের সমস্যা। সে কারবারের সুবাদে অস্ত্র, টাকা, পেশিশক্তি— কোনওটাই জোগাড় করা কঠিন নয়।
রাজনৈতিক হিংসার কারণে দিনহাটা শিরোনামে ওঠার পরে, একাধিক বার কোচবিহারে পুলিশ সুপার বদল হয়েছে। একাধিক বার রাজ্যপাল এসেছেন এলাকায়। তবে পরিস্থিতি বদলায়নি। ২০১৮ সালের প্রায় শেষ পর্যন্ত নিশীথ যখন তৃণমূলের যুব সংগঠনে ছিলেন, তখন দিনহাটা ‘সন্ত্রস্ত' ছিল। সে সময় যুযুধান ছিল মূল তৃণমূল বনাম যুব তৃণমূল। তখন থেকেই কি এলাকায় কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়েছিল? নিশীথের জবাব, “এত কথা আপনার সঙ্গে বলব না।”
গত পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে বিজেপি কর্মী প্রশান্ত রায় বসুনিয়া খুন হয়েছিলেন। প্রশান্তের পড়শি তরুণকুমার বর্মণের অভিযোগ, “রাজনীতি করি না। কোনও দিন রাজনৈতিক দলের মিছিলেও যাইনি। অথচ, প্রশান্তর পড়শি বলে আতঙ্কে থাকি। মনে হয়, এই বুঝি কেউ আমাদেরও অমুক পক্ষ বলে দেগে দিয়ে আক্রমণ না করে বসে!”
ছাড় নেই জন-প্রতিনিধিদেরও। গত বিধানসভা নির্বাচনের পরেই দিনহাটার পাওয়ারহাউস মোড়ে আক্রান্ত হন বর্তমান উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ। এ দিনও (রবিবার) উদয়নের গাড়িতে হামলার অভিযোগ ওঠার পরে সেই নিশীথ কনাম উদয়নের তাল ঠোকাঠুকি।
লোকসভা নির্বাচন সামনে আসতেই তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতি স্তরের প্রতিনিধি কিংবা বিজেপি নেতাদের বাড়ির সামনে বোমাবাজির অভিযোগ উঠছে। আবার কেন্দ্র এবং রাজ্যের মন্ত্রীকে পরস্পরের দিকে তেড়ে যেতেও দেখেছে দিনহাটা। দিনহাটা চৌপথি এলাকাতেই চশমার দোকান অপূর্ব সাহা বলেন, “ওই গোলমালের পর থেকে একটা ভয় কাজ করছে। না জানি, কবে আবার কী হয়!”
ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রউফের মন্তব্য, “আসলে দুই দলের দুই মন্ত্রী সন্ত্রাস কায়েম করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। তাই দিনহাটার আজ এই দশা।” নিশীথের অভিযোগ, “তৃণমূলের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। তাই তৃণমূল এ ধরনের কাজ করছে।” দিনহাটাকে ‘সন্ত্রস্ত’ বলে মানতে না চাইলেও উদয়নের পাল্টা অভিযোগ, "দিনহানির রাজনীতিকে উত্তপ্ত করার মূল কারিগর হলেন নিশীথ প্রামাণিক।”
এই অবস্থায় নিচুতলার দলীয় কর্মী ও সাধারণ মানুষ কেমন আছে, সেটা প্রশান্তের মা সুচিত্রা রায় বসুনিয়ার কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। নিহত বিজেপি কর্মীর মা সুচিত্রা বলেন, “ভোট এলেই ঠাকুরকে বলি, আর কোনও মায়ের কোল যেন খালি না হয় !”