Kartik Maharaj on Mamata Banerjee

‘তৃণমূল-বিজেপি দুই দলই ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেয়’! মমতার ‘রাগ’ নিয়ে মন্তব্য কার্তিক মহারাজের

সনাতনী সংগঠনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের জন্য অবারিত দ্বার। জনপ্রিয়তার সঙ্গে বার বার বিতর্কেও জড়িয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কী প্রতিক্রিয়া কার্তিক মহারাজের?

Advertisement

প্রণয় ঘোষ

বেলডাঙা শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ২১:২৯
Share:

(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কার্তিক মহারাজ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

কার্তিক মহারাজ। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের এই সন্ন্যাসী এখন রাজ্য রাজনীতিতে আলোচিত নাম। নির্বাচনী প্রচার থেকে তাঁকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নাম নিয়ে সমালোচনা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনার পাল্টা হিসাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিন্দা করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের। এত কিছু যাঁকে নিয়ে, তিনিও এ বার বোমা ফাটালেন। দাবি করলেন, বিজেপি তো বটেই তৃণমূলের তরফেও তাঁকে এই নির্বাচনে প্রার্থী করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজি হননি।

Advertisement

কে এই কার্তিক মহারাজ? ছোটবেলায় দেখেছিলেন গেরুয়া পোশাক পরিহিত একদল লোক গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের সেবাশুশ্রূষা করছেন। দিনের শেষে সূর্যাস্তের ঠিক আগে সেদ্ধ ভাত খেয়ে মাটির বারান্দায় খড় বিছিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। পরে জেনেছিলেন, গেরুয়া পোশাক আর মাথায় পাগড়ি পরা লোকগুলো গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। এক সন্ন্যাসীর সহচর্যে কিশোর বয়সে সেবাব্রত নিয়ে যোগ দেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের বাঁকুড়া শাখায়। ১২ বছর ব্রহ্মচর্য পালনের পর কলকাতার বালিগঞ্জ শাখায় থেকে সন্ন্যাসজীবন শুরু।

সন্ন্যাসগ্রহণের কিছু দিনের মধ্যেই দায়িত্ব পান মুর্শিদাবাদের। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলায় সংগঠন বিস্তারের ভার পড়ে তার উপরে। মুর্শিদাবাদের গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বইতে দেখেছেন তিনি। গ্রামীণ এলাকায় একের পর এক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। সনাতনী সংগঠনের অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের জন্যও অবারিত দ্বার। জনপ্রিয়তার সঙ্গে বার বার বিতর্কেও জড়িয়েছেন তিনি। চলতি লোকসভা নির্বাচনে একাধিক কেন্দ্র থেকে তার প্রার্থী হওয়ার খবর চাউর হয়েছিল। দীর্ঘ ৩৮ বছর মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমিক হিসাবে রয়েছেন কার্তিক মহারাজ।

Advertisement

তাঁর অনুগামীরা বলেন, এক জন হিন্দু সন্ন্যাসীর সংখ্যালঘু এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সহজ ছিল না। তার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল প্রথমেই। সে সব বাধা কাটিয়ে অচিরেই সব সম্প্রদায়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেন কার্তিক মহারাজ। সংসারের হাল ধরতে অল্প বয়সে যে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো হত, প্রথমেই তাদের স্কুলমুখী করার লক্ষ্যে নেমে পড়েন মহারাজ। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তোলেন একের পর এক অবৈতনিক স্কুল। বেলডাঙা, অরঙ্গবাদ, ফরাক্কা, জলঙ্গী মিলিয়ে চারটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আটটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় তার উদ্যোগে। সব মিলিয়ে আট হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী সেখানে পড়াশোনা করে, যার মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। শুধু বিদ্যালয় নয়, মুর্শিদাবাদের অভিশাপ বাল্যবিবাহ রুখতে একাধিক প্রকল্প রূপায়িত হয় কার্তিক মহারাজের উদ্যোগে। মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ, নানাবিধ হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। দুশোর বেশি অনাথ শিশুর পড়াশুনার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। এক হাজারেরও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েকে বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। মহারাজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় থেকে রাজ্যের মাধ্যমিক পরীক্ষায় দশম স্থান অধিকার করেছিল এক আদিবাসী ছাত্রী, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ইতিহাসে যা আজও সর্বকালীন রেকর্ড।

এ সব কর্মকাণ্ডের আগেও কার্তিক মহারাজকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল জেলার দু’টি বিপর্যয়। ১৯৯৮ সালের গোকর্ণের ভয়াবহ টর্নেডোর পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে থেকে দীর্ঘ ছ’মাস সেবার কাজ চালিয়েছিলেন তিনি। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বহরমপুরের উপকণ্ঠে ফরাসডাঙ্গায় ৫০ হাজার কণ্ঠে গীতাপাঠের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনিই। মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি সমগ্র উত্তরবঙ্গের সংগঠন বিস্তারের ভার তাঁর উপরে। জনপ্রিয়তা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, একের পর এক বিতর্কেও জড়িয়েছেন কার্তিক মহারাজ। জগদ্ধাত্রী পুজোকে কেন্দ্র করে অশান্তির ঘটনায় মহারাজের বিরুদ্ধে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ তুলেছিলেন স্থানীয়দের একাংশ। এ ছাড়াও বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছিল মহারাজের বিরুদ্ধে। যদিও সে সব অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়েছেন কার্তিক মহারাজ।

রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়ায় প্রদীপ্তানন্দ ওরফে কার্তিক মহারাজ বলেন, ‘‘আমরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। যে সমস্ত সন্ন্যাসী রাজনীতির আঙ্গিনায় এসেছেন, তাঁরা তাঁদের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে তার পর এসেছেন। তবে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যাওয়ার কোনও ইচ্ছা আমার নেই।’’ এ বারের লোকসভা ভোটে রায়গঞ্জ কেন্দ্র থেকে তাঁর প্রার্থী হওয়া নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল। সে প্রসঙ্গে জানতে চাওয়ায় কার্তিক মহারাজ বলেন, ‘‘শুধুমাত্র রায়গঞ্জ নয়, বহরমপুর ও কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকেও আমি প্রার্থী হচ্ছি বলে একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী কালে আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, আমি সন্ন্যাসী মানুষ, রাজনীতিতে কোনও উৎসাহ নেই।’’ রাজনীতি করলে কোন দলে যোগ দেবেন? মহারাজের জবাব, ‘‘আমাকে তৃণমূল ও বিজেপি, উভয় দলই প্রার্থী হওয়ার জন্য বার বার প্রস্তাব দিয়েছে। এর আগের বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল। আমি সবিনয়ে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করি। এ বছর বিজেপির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। তৃণমূলের শীর্ষনেতারাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আমার কোনও উৎসাহ নেই।’’ তাঁর সম্পর্কে করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য প্রসঙ্গে কার্তিক মহারাজ বলেন, ‘‘আমাকে খুব বেদনাহত করেছে। এটা ব্যক্তি হিসাবে আমার অপমান নয়, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের দীর্ঘ দিনের সেবাব্রতী পরম্পরার অপমান।’’ খানিকটা অভিমানের সুরে তাঁর সংযোজন, ‘‘নিজের শ্রাদ্ধ করে সন্ন্যাস নিয়েছি, মুখ্যমন্ত্রী আর কী করবেন!’’ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সন্ন্যাসীদের পাশে দাঁড়ানোর ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।

হুগলির নির্বাচনী জনসভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, “সব সাধু সমান হয় না। সব স্বজন সমান হয় না। আমাদের মধ্যেও কি আমরা সবা‌ই সমান? এই যে বহরমপুরের এক জন মহারাজ আছেন। আমি শুনেছি অনেক দিন ধরে, কার্তিক মহারাজ। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। আমার শ্রদ্ধার্ঘ্যের তালিকায় তারা দীর্ঘ দিন ধরে আছে। কিন্তু যে লোকটা বলে, তৃণমূল কংগ্রেসের এজেন্ট বসতে দেব না, সেই লোকটাকে আমি সাধু বলে মনে করি না। তার কারণ, সে ডাইরেক্ট পলিটিক্স করে দেশটার সর্বনাশ করছে।’’

প্রসঙ্গত, কার্তিক মহারাজ ওরফে স্বামী প্রদীপ্তানন্দ মহারাজ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ট্রাস্টি সদস্য। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় সঙ্ঘের যে শাখা রয়েছে সেটিকে কেন্দ্র করে তিনি বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করেন। কলকাতায় ব্রিগেডে ও বহরমপুরের ফরাসডাঙ্গায় গীতাপাঠের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। মহারাজ বলছেন, এ কারণেও হয়তো মুখ্যমন্ত্রী ‘রাগ’ করতে পারেন তাঁর উপর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement