ছবি: সংগৃহীত।
দীর্ঘ ২৫ বছরের ঘাঁটির পতন হয়েছে। হতাশায় একেবারে নিমজ্জিত না হলেও পরাজিত সেনাপতি রণক্লান্ত বটেই! কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর কাছে বার্তা এল রাহুল গান্ধীর। ফোনে কথা বললেন মল্লিকার্জুন খড়্গে। তাঁদের বার্তা পাওয়ার পরে ভাঙা মন নিয়েই দিল্লি গেলেন অধীর চৌধুরী। সঙ্গে উড়ে চলল জল্পনা, বাংলায় কংগ্রেসের এ বার কী হবে!
এ বারে বহরমপুরের লড়াই যে অত্যন্ত কঠিন ছিল, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই তা পরিষ্কার। সেই আবহে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতাদের কাউকে দেখা যায়নি। অধীর নিজে ডাকেননি বলে তাঁরা আসেননি, নাকি ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের বিবেচনায় এড়িয়ে গিয়েছেন, সেই প্রশ্নে নানা মত আছে। তারই মধ্যে আবার ভোট-পর্ব চলাকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরকে কড়া বার্তা দিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি খড়্গে। দু’দিন বাদে সংশোধনও করেছিলেন। তবে ভোটের ফল বেরোনোর পরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং বিদায়ী লোকসভার দলনেতাকে বার্তা পাঠিয়েছেন রাহুল। খড়্গেও তাঁকে ফোন করেছিলেন বৃহস্পতিবার রাতে। কী কথা হল? অধীরের কথায়, ‘‘খড়্গেজি নিজেই ফোন করেছিলেন। বললেন, এই ফলে (বহরমপুর) সত্যিই খারাপ লাগছে। দিল্লিতে এআইসিসি-র ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠক আছে। সেখানে যাতে অবশ্যই যোগ দিই, সেই কথা বলেছেন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমার সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে আবার একটা প্রচার চালানো হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়।’’
বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে এক সময় টানা জিতেছিল আরএসপি। সেখান থেকে ১৯৯৯ সালে চাকা ঘুরিয়েছিলেন অধীর। সেই ইনিংসের সমাপ্তি হয়েছে ২০২৪-এ প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানের কাছে হেরে। তিন বছর আগে বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্রেও হেরে গিয়েছিল কংগ্রেস। পাঁচ বছর আগে যে বহরমপুর লোকসভা আসন ধরে রাখতে এই বিধানসভাই ছিল অধীরের প্রধান সহায়। তিন বছরের ব্যবধানে বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্র পুনরুদ্ধার করেছে কংগ্রেস, তবে ২০১৯ সালের চেয়ে ব্যবধান অনেক কম। আর বাকি ৬টি বিধানসভার ৫টিতেই ‘লিড’ নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, বড়ঞায় ৫৫৮ ভোটে এগিয়ে বিজেপি। সব মিলিয়ে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে তিন লক্ষ ৭১ হাজার ৮৮৫ ভোট পেয়েছেন বিজেপি প্রার্থী, বহরমপুরের পরিচিত চিকিৎসক নির্মল কুমার সাহা। প্রাথমিক পর্যালোচনায় উঠে আসছে, বিজেপির এই উত্থানই কংগ্রেস সাংসদের পতনের কারণ। অধীর নিজেও তেমনই মনে করছেন।
বাংলার কংগ্রেস সভাপতি আসলে ‘বিজেপির লোক’, এই মর্মে টানা আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। লোকসভার ফল বেরোনোর পরেও স্বয়ং মমতা একই কথা বলেছেন। কংগ্রেসের একাংশের মতে, বহরমপুরে এ বার হেরে গিয়ে অধীরের ‘শাপে বর’ই হয়েছে! একে নিজের পরাজয় এবং সেটাও মূলত বিজেপির কারণে, এর পরে কি বিজেপির সঙ্গে ‘আঁতাঁতে’র তত্ত্ব যুক্তিগ্রাহ্য হবে? ওই অংশের প্রশ্ন, নিজে জেতার জন্য যিনি বিজেপির সঙ্গে ‘গোপন আঁতাঁত’ করবেন, তিনি নিজের হারের রাস্তা প্রশস্ত করে তৃণমূলের হাতে আসন তুলে দিতে সাহায্য করবেন?
কংগ্রেসের অন্দরে এখন জল্পনা, এর পরে কি অধীরকে আর সভাপতি রাখবে এআইসিসি? প্রদেশ কংগ্রেস পরিচালনায় যুক্ত কিছু নেতার কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে দলের একাংশের অবস্থান অনেক আগে থেকেই বর্তমান সভাপতির বিরুদ্ধে। লোকসভার ফলের পরে তাঁরা বাড়তি অস্ত্র পেয়েছেন! আবার কে সি বেণুগোপাল, জয়রাম রমেশ-সহ এআইসিসি-র নেতারা গোটা নির্বাচনে এমন মনোভাব নিয়ে চলেছেন, যাতে মনে হয়েছে বাংলায় কংগ্রেস কেমন ফল করবে, তাতে কিছুই যায় আসে না! তৃণমূল সন্তুষ্ট থাকলেই হল! আর তৃণমূলের পথে কাঁটা হচ্ছিলেন প্রদেশ সভাপতি! দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ শক্তিশালী হওয়া এবং মমতার দলের ফের গুরুত্ব বাড়ার পরে সেই ‘কাঁটা’ কি সরিয়ে ফেলবে এআইসিসি?
দলেরই অন্য অংশ অবশ্য মনে করে, সিপিএমের সঙ্গে সমঝোতা করে এই লোকসভা নির্বাচনে গত বিধানসভা ভোটের চেয়ে খারাপ ফল তো হয়ইনি, বরং কিঞ্চিৎ এগোনো গিয়েছে। এই সমঝোতা ধরে রেখেই ২০২৬-এর জন্য এখন থেকে তৈরি হওয়া উচিত। ফের সমঝোতা ভাঙলে বা তৃণমূলের হাত ধরতে গেলে কংগ্রেসের ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ বলে কিছু থাকবে না। ভোটের সময়ে অধীরও বাম-সঙ্গ ধরে রাখার পক্ষেই সায় দিয়েছিলেন। এখনও কি দিল্লির কাছে সেই সওয়াল করবেন? অধীরের বক্তব্য, ‘‘বাংলায় বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে ভাবার পরিস্থিতি এআইসিসি-র কাছে এখন আছে বলে মনে হয় না। বাংলার পরিস্থিতি বিচার করে এবং দলকে বাঁচানোর স্বার্থেই এখানে রাজনৈতিক লড়াই করেছি, ব্যক্তিগত কিছু ছিল না। দিল্লি মত জানতে চাইলে তখন বলব।’’