মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
কেন্দ্র টাকা দিতে পারলে ভাল, না পারলে রাজ্যে চালু নানা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা তাঁর সরকারই মেটাবে বলে জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরুলিয়ার প্রশাসনিক সভার মঞ্চে মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, ‘‘বাংলা হকের টাকা চায়। বাংলা ভিখারি নয়। কাউকে ভিক্ষা করতে হবে না।’’
প্রাপ্য আদায়ের জন্য এত দিন কেন্দ্রের কাছে অনুরোধ-উপরোধ-আন্দোলন সবই করেছে তৃণমূল। তাতে লাভ হয়নি। টাকা না পাওয়ায় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিতেও দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু এ বার মমতা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করলেন, বাংলা আর কেন্দ্রের ‘মুখাপেক্ষী’ হয়ে থাকবে না। লোকসভা ভোটের আগে মমতার যে ঘোষণা এই জল্পনা তৈরি করছে যে, কেন্দ্রবিরোধী প্রচারের অভিমুখ বদলাচ্ছেন মমতা। কারণ, তাঁর ‘কেন্দ্র আমাদের টাকা দিচ্ছে না’ বক্তব্যটি ক্রমে বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তে জোরালো হচ্ছে ‘কেন্দ্রের টাকা আমিই দিচ্ছি’ বক্তব্যটি।
সোমবার থেকে বাংলার শ্রমিকদের ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের টাকা দেওয়ার কাজ শুরু করেছে মমতার সরকার। তার পর দিন মঙ্গলবার ছিল পুরুলিয়ার প্রশাসনিক সভা। মমতা সেখানেও জানান, তাঁর সরকার ১০০ দিনের কাজের টাকা দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘অনেকের অ্যাকাউন্টেই টাকা পৌঁছে গিয়েছে। বাকিদেরও ২-৩ দিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে।’’ তার পরেই মমতা টেনে আনেন কেন্দ্রের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রের হিসাবে ছিল ২১ লক্ষ শ্রমিকের নাম। কিন্তু এখন আমরা দেখছি সংখ্যাটা ৫০ লক্ষ। এই ৫০ লক্ষ শ্রমিককে আমরাই টাকা দেব। ভোটের সময় মোদীকে জবাব দিতে হবে, কেন তিনি ১০০ দিনের কাজের টাকা দেননি!’’ প্রায় একনিঃশ্বাসে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার কথা বলেন মমতা। এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকাও বন্ধ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। মমতা ঘোষণা করেন, ‘‘আবাস যোজনার টাকাও আমরা দেব। ১ এপ্রিল পর্যন্ত দেখব। তার মধ্যে কেন্দ্র টাকা না ছাড়লে যে ১১ লক্ষ বাড়ি নথিভুক্ত রয়েছে, যাঁরা সার্টিফিকেট পেয়েও বাড়ি পাননি, তাঁদের বাড়ি বানানোর টাকা রাজ্য সরকার দেবে।’’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, তাঁর ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’ পরিষেবায় বাড়ি সংক্রান্ত যে সমস্ত আবেদন জমা পড়েছে, সে সব মিলিয়ে মোট ১৬-১৭ লক্ষ আবেদন জমা হয়ে থাকতে পারে। মমতা বলেন, ‘‘সব আমি দিয়ে দেব। তার পরেও যা বাকি থাকবে পর্যায়ক্রমে করে দেব। কাউকে ভিক্ষা করতে হবে না। বাংলা ভিখারি নয়। বাংলা হকের টাকা চায়। অধিকারের টাকা চায়।’’
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ‘রাম আবেগ’-এর মোকাবিলায় লোকসভা ভোটে ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’র আখ্যান রচনার কাজ পরিকল্পিত ভাবে শুরু করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই প্রথম ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকার বিষয়টি নিয়ে জোরালো আন্দোলন শুরু করেন। প্রথমে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে, তাঁকে স্মারকলিপি দিয়ে পরে বঞ্চিতদের রাজধানী দিল্লির রাজপথে নিয়ে গিয়ে অবস্থান করে গ্রেফতার হয়ে, ফিরে এসে কলকাতার রাজভবনের সামনে টানা অবস্থান করে অভিষেক ওই আন্দোলনকে তুঙ্গে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তার পরে বিভিন্ন কারণে অভিষেকের সঙ্গে দলের ‘দূরত্ব’ তৈরি হওয়ায় তিনি ওই আন্দোলন থেকে নিজেকে খানিকটা গুটিয়েই নিয়েছিলেন। সেই আন্দোলনের রাশ নিজে হাতে নিয়েছিলেন মমতা। তিনি সাংসদদের প্রতিনিধিদল নিয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ওই অর্থের দাবি জানিয়েছিলেন। তার পরেও অর্থ মেলেনি। এর পরেই মমতা রাজ্যের তহবিল থেকে ওই অর্থ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তত দিনে অভিষেকও দলের মূলস্রোতে ফিরে এসেছেন। ঘটে গিয়েছে সন্দেশখালির ঘটনাপ্রবাহ।
এই আবহেই ১০ মার্চ তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশ। ‘জনগর্জন’ নামের ওই সভা থেকেই তৃণমূল পূর্ণোদ্যমে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের ময়দানে নামতে চলেছে। অভিষেকের পরিকল্পনা, লোকসভা ভোটে ‘কেন্দ্রবিরোধী আখ্যান’ রচনা করতে হবে এই মর্মে যে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বাংলার মানুষকে ‘ভাতে মারতে’ চাইছে। তাঁদের প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না। দিচ্ছে মমতার নেতৃত্বে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ, তৃণমূলের নতুন আখ্যানে রাজ্যের তৃণমূল সরকার ‘বঞ্চিত’ হয়েও কেন্দ্রীয় বঞ্চনার মূল্য চোকানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। সেই সুরই মঙ্গলবার পুরুলিয়ার সভা থেকে বেঁধে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী। যে ‘জনগর্জন’-এর পরিকল্পনা ‘তৃণমূলের সেনাপতি’ অভিষেক করেছেন, তার নান্দীমুখ পুরুলিয়ার প্রশাসনিক সভা থেকে মমতা করে দিলেন বলেও মনে করছেন দলের শীর্ষনেতারা।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার পুরুলিয়ার ওই সভায় আরও কিছু ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ১০০০ নতুন বনকর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃষকদের থেকে চাল কেনা এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘বড় বাজার’ বা ‘বিগ মার্কেট’ তৈরি করে দেওয়ার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
১০০০ বনকর্মী নিয়োগ
মমতা জানান, বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আক্রমণে যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের পরিবার থেকে এক জনকে চাকরি দেওয়া হবে। আপাতত ১০০০ ভলান্টিয়ার নিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। এঁরা মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনের চাকরি পাবেন। মমতা বলেন, ‘‘এই ধরনের ঘটনায় ৭৩৮টি আবেদন এসেছিল আমার কাছে। তাই ১০০০টি পদ তৈরি করেছি। আগামী দিনে এই ধরনের ঘটনায় মৃতের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে অর্থসাহায্যও করা হবে।’’
কৃষকদের বাড়ি গিয়ে চাল কেনা
দিল্লিতে যখন ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে কৃষক আন্দোলন চলছে, তখন কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল কিনে আনার কথা বলেছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘খাদ্য দফতরের গাড়ি পৌঁছে যাবে কৃষকদের বাড়িতে। দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে চাল কিনে নিয়ে আসবে। আমরা চাই আমরা যে চাল বিনামূল্যে রেশনে দিই, তা আমাদের কৃষকদেরই ফলানো চাল হোক।’’
স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য বিগ মার্কেট
পুরুলিয়ার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের তসর বুনতে দেখে মমতা নির্দেশ দেন, ওই শাড়ি বাংলার হাট, বাংলার শাড়ি এবং বিশ্ব বাংলার বিপণিতে রাখতে হবে। মমতা এর পরে জানান, তিনি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য প্রতিটি জেলায় একটি করে বড় বাজার খুলে দেবেন। সেখানে শুধুই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজ থাকবে। পর্যটকেরা সেখান থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারবেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের কাজের সুবিধার জন্য ৫ লক্ষ টাকার ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।