লক্ষ্মীর ভান্ডার। —ফাইল চিত্র।
বাংলায়, এমনকি, উত্তরবঙ্গের কয়েকটি আসনে তৃণমূলের ভাল ফল বা হারের ব্যবধান কমিয়ে আনার পিছনে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের অবদান অনেক বলেই মনে করছেন দলের কর্মী-সমর্থক থেকে সাধারণ বাসিন্দাদের অনেকে। যাঁরা উপভোক্তা, তাঁদের একটা বড় অংশ এতে খুশি। এ বছর উত্তরবঙ্গে কোচবিহারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিককে হারিয়ে সে আসন দখল করেছে তৃণমূল। বালুরঘাট লোকসভার মতো আসনে অল্পের জন্য জয় হাতছাড়া হয়েছে তাদের। কংগ্রেস-বামের জোটপ্রার্থী আলি ইমরান রম্জ না থাকলে রায়গঞ্জের মতো আসনও হাতে আসত বলে তৃণমূলের অনেকে মনে করছেন। মোটের উপরে এমন ফলের পিছনে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর অবদান অনেকাংশ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমনকি, বিজেপি বিধায়ক তথা অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ি ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর প্রশংসা করেছেন। বালুরঘাটের বিজেপি বিধায়ক বলেন, ‘‘বাংলায় তৃণমূলের ফল ভাল হওয়ার বিষয়টি সব কিছু না দেখে, বলা যাবে না। সবে পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। কেন এমন হল, প্রশ্নপত্র কঠিন না আমরা লেখাপড়া করিনি বেশি, না ওরা বেশি করেছে— এত সহজে বললে ভুল হতে পারে।’’ তবে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার খুব ভাল প্রকল্প। এর চেয়ে ভাল জিনিস আর হয় না। কিন্তু এক ভদ্রমহিলাকে ১,২০০ টাকা ধরিয়ে দিলেন আর বলবেন, তোমার স্বামী যাবে অন্ধ্রপ্রদেশে ধান বুনতে, ছেলেটাকে পাঠিয়ে দাও হরিয়ানায়, দিনমজুরের চাকরি করবে। তাতে মুশকিল। তবে লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কায়েমি উন্নয়নের জন্য যা দরকার, সেগুলোও করুন।’’
এক সময় বাম মনোভাবাপন্ন অধ্যাপক সংগঠনের সদস্য তথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কনক বাগচী বলেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটি খুবই ভাল। কেননা, গরিব পরিবার, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের কাছে কোনও মহিলা মাসে এক হাজার বা ১,২০০ টাকা করে পাচ্ছেন। এটা অনেক বড় ব্যাপার। সকলে সেটা বুঝতে পারবেন না। বাম নেতারা সেটা করে উঠতে পারেননি। হয়তো বুঝতে পারেননি এ ধরনের কোনও প্রকল্প হতে পারে।’’
রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অনিল ভুঁইমালির মতে, ‘‘আয় কম যে সমস্ত পরিবারের, সেই মহিলারা লক্ষ্মীর ভান্ডারে যে এক হাজার টাকা পান, সেটা সংসারে বিরাট ভূমিকা নেয়। তৃণমূলের পক্ষে মানুষের একাংশের থাকার পিছনে এটা একটা বড় কারণ। তারা মনে করছে, যতদিন রাজ্যে এই সরকার থাকবে ততদিন পাবে। অন্য দিকে, ১০০ দিনের কাজের টাকা বাকি থাকায় বঞ্চনার প্রভাবও আছে। কেন্দ্র না দিলেও রাজ্য জানায়, তারা দিয়ে দেবে। সেটা কাজ করেছে। কারণ, প্রচুর গ্রামের মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত।’’
যাঁরা প্রকল্পের সুবিধা পান তাঁরা কী মনে করছেন? মাটিগাড়ার বাসিন্দা মেনকা অধিকারী বলেন, ‘‘আমার মতো বহু মানুষ লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে উপকৃত হচ্ছেন। এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই।’’ চা বাগানে তৃণমূল জোর লড়াই দিয়েছে। তবে বন্ধ কালচিনি চা বাগান শ্রমিক লালো ওরাওঁ জানান, ‘লক্ষীর ভান্ডার’-এর তেমন প্রভাব চা বাগানে পড়েছে বলে তাঁর মনে হয় না। তা হলে আলিপুরদুয়ার লোকসভায় ফলাফল অন্য রকম হত। তাঁর সংযোজন: ‘‘রাজ্য সরকারের চা বাগান নিয়ে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যাতে চা বাগান ছেড়ে শ্রমিকদের বাইরে কাজে যেতে না হয়।’’
প্রত্যন্ত এলাকার নেতারা কী বলছেন? তৃণমূলের কোচবিহার ১(বি) ব্লকের সভাপতি আব্দুল কাদের বলেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার মানুষের অনেক উপকার করেছে।’’ বিজেপির পানিশালা মণ্ডলের সভাপতি অবিরাম মণ্ডলের আবার দাবি, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের থেকেও বড় যোজনা বিজেপি-শাসিত রাজ্যে চলছে। আসলে তৃণমূলকে মানুষকে ভুল বুঝিয়েছে।’’
শিলিগুড়ি মহকুমায় তৃণমূল পিছিয়ে। মহকুমা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ তথা খড়িবাড়ি ব্লক তৃণমূলের সভাপতি কিশোরীমোহন সিংহ বলেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের সুবিধাভোগীদের কাছে আরও ভাল করে পৌঁছতে হবে। বিজেপির ভুল ব্যখ্যার প্রভাবও কিছুটা পড়ে থাকতে পারে।’’