—প্রতীকী চিত্র।
লোকসভা ভোটের প্রচার চলছে পুরোদমে। অথচ, বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক স্বপন মজুমদারকে নিজের বিধানসভা এলাকায় ভোটের প্রচারে দেখা যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন দলেরই অনেকে। কারণ, স্বপনকে এ বার বিজেপি বারাসত লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই নিজের প্রচারে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। বিধায়কের অনুপস্থিতিতে বনগাঁ দক্ষিণে বিজেপির সেই ঝাঁঝালো প্রচার দেখা যাচ্ছে না বলে অনেকেই জানাচ্ছেন। অভিযোগ, বিধানসভা এলাকায় বিজেপি কিছু নেতা-কর্মীকেও এখনও প্রচারে তেমন গা ঘামাতে দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ বাইরের লোকসভা কেন্দ্রে গিয়ে প্রচার করছেন। এ ছাড়া, এই এলাকায় দলের গোষ্ঠীকোন্দলও বিজেপির মাথাব্যথার কারণ।
স্বপন অবশ্য বলেন, “আমি বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের প্রচারে বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে কোনও কর্মী আনিনি। কর্মীরা ওখানে কাজ করছেন আমার নির্দেশেই। শেষ দিকে দু’একটি সভা করার পরিকল্পনা আছে আমার। বনগাঁ দক্ষিণ থেকে বিজেপিকে লিড দেওয়াটা আমার দায়িত্ব।”
লোকসভা ভোটের প্রার্থী ঘোষণার আগে পর্যন্ত বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুরের সঙ্গে স্বপনের দূরত্ব ছিল অনেকটাই। প্রায় এক বছর ধরে দু’জনকে এক সঙ্গে দলীয় কর্মসূচিতে কার্যত দেখা যায়নি। কিন্তু বারাসতের প্রার্থী হিসেবে স্বপনের নাম ঘোষণার পর থেকে কাছাকাছি আসেন শান্তনু-স্বপন। পাল্লা এলাকায় এক সঙ্গে মিছিলও করেছেন। বিজেপির বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের আহ্বায়ক চন্দ্রকান্ত দাস বলেন, “এটা ঠিকই যে এলাকার বিধায়কের ভোট প্রচারের একটা গুরুত্ব থাকে। এ ক্ষেত্রে তিনি বারাসতে প্রার্থী হয়েছেন। তবে আমরা সাংগঠনিক ভাবে তাঁর অভাব পূরণ করতে পেরেছি। দলের সকলে একত্রে প্রচার করছেন। আমাদের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝি নেই।”
২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে বনগাঁ কেন্দ্রটি ভেঙে বনগাঁ উত্তর এবং বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা তৈরি হয়। বনগাঁ ব্লক এবং গাইঘাটা ব্লকের ১২টি পঞ্চায়েত নিয়ে বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা হয়। ২০১১ এবং ২০১৬ সালের ভোটে তৃণমূল প্রার্থী সুরজিৎ বিশ্বাস জয়লাভ করেছিলেন। ২০১৯ সালের আগে পর্যন্ত এখানে শাসক দলের একচেটিয়া দাপট ছিল। ছন্দপতন হয় ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে। সে বার বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর এই বিধানসভা থেকে লিড পেয়েছিলেন প্রায় ২৯ হাজার ভোটে। পরে ২০২১ সালের বিধানসভায় এখানে জেতেন স্বপন।
গত লোকসভায় তৃণমূলের ভরাডুবির কারণ কী?
তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করেন, বামেদের ভোট বিজেপির দিকে চলে যাওয়া ছিল এর বড় কারণ। চাঁদপাড়া এলাকায় আনাজ বাজার তুলে কিসান মান্ডিতে নিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে রোজগার নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তারও প্রভাব পড়েছিল লোকসভা ভোটে। তবে শাসক দলের নেতাদের মধ্যে অনৈক্য, কিছু নেতার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগেরও কিছু ভূমিকা ছিল বলেই দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের অনেকে মনে করেন।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে এখানে তৃণমূল পরাজিত হলেও পরাজয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ২০০৪ ভোটের। ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে সভাও করতে এসেছিলেন। এ বারের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি হওয়ার পর থেকে এখানে নিয়মিত কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে জনসংযোগ বাড়িয়েছেন। ‘বসে যাওয়া’ কর্মীদের সক্রিয় করেছেন। নতুন প্রজন্মের অনেকেকে তুলে আনা হয়েছে। গোষ্ঠী কোন্দল অন্তত প্রকাশ্যে মিটেছে। সুফল মিলেছে গত পঞ্চায়েত ভোটে। বিধানসভার ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১১টিতে তৃণমূল জয়লাভ করেছে। ১টি জেতে বিজেপি। দু’টি পঞ্চায়েত সমিতিও তৃণমূল দখল করেছে।
যদিও বিরোধীদের দাবি, পঞ্চায়েত ভোটে মানুষের প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন হয়নি। সন্ত্রাস, ভোট লুট, রিগিং, ছাপ্পা, গণনায় কারচুপি হয়েছিল। বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডল বলেন, “এ বার ভোটে মানুষ পঞ্চায়েতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে তৃণমূলকে উচিত শিক্ষা দেবেন।” পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের সন্ত্রাসের অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ বলেন, “এখানকার সাংসদ, বিধায়ক বিজেপির। অথচ, ওরা মানুষের কোনও উন্নয়ন করেননি। মানুষের পাশে ছিলেন না। ২০১১ এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের ফলেরই এ বার প্রতিফলন হবে।” তবে তৃণমূল সূত্রের খবর, গাইঘাটার প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা গোবিন্দ দাস অসুস্থতার কারণে প্রচারে সময় দিতে পারছেন না। নিচুস্তরে নেতা-কর্মীদের মধ্যেও কোন্দল রয়েছে। এ সবের প্রভাব পড়তে পারে ভোটে।
এই বিধানসভা এলাকায় মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষদের যথেষ্ট সংখ্যায় বসবাস। স্বাভাবিক ভাবেই সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন) কার্যকর করার বিজ্ঞপ্তি জারির প্রভাব উদ্বাস্তু মানুষদের মধ্যে পড়েছে। তাঁরা সিএএ-এর পক্ষে না বিপক্ষে কোন দিকে রায় দেবেন, তার উপরেও এই বিধানসভায় রাজনৈতিক দলগুলির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
লড়াইয়ে রয়েছে বাম-কংগ্রেসও। জোটের হয়ে লড়ছেন কংগ্রেসের প্রদীপ বিশ্বাস। তবে বাম-কংগ্রেসের সংগঠন এলাকায় একেবারে তলানিতে। গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেস এখানে পেয়েছিল ১৬৭১ ভোট। সিপিএম পেয়েছিল ৮২১২ ভোট। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, যতটা সম্ভব ভোট বাড়িয়ে নেওয়াই লক্ষ্য বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর।