বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় সাজমু নিসা। শনিবার, হাওড়া জেলা হাসপাতালে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
পথ হারিয়ে কোনও ভাবে হাওড়ায় চলে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু কাঁপা হাতে ইভিএমের বোতাম টিপে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার কথা ভোলেননি ৯৫ বছরের সাজমু নিসা। বিহারের বাঁকা জেলার ওই প্রবীণ বাসিন্দা গ্রামের বাড়িতে ফিরতে চেয়ে হাওড়া পুলিশ থেকে হাওড়া জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স এবং হ্যাম রেডিয়োর সদস্যদের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। চেয়েছেন, শেষ বারের মতো গ্রামের স্কুলবাড়িতে গিয়ে ভোট দিতে। অবশেষে সকলের চেষ্টায় বিহারে তাঁর পরিবারের খোঁজ মিলেছে। খবর পেয়ে নবতিপর ‘নানি’কে ঘরে ফেরাতে সেখান থেকে ইতিমধ্যেই রওনা দিয়েছেন তাঁর নাতিপুতিরা।
জানা গিয়েছে, প্রবল গরমের মধ্যে একটু জল ও খাবারের জন্য সম্প্রতি হাওড়ার গোলাবাড়ি থানা এলাকার পানিট্যাঙ্কি মোড়ের কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছিল ওই বৃদ্ধাকে। শীর্ণ চেহারা, পরনে সাদা ধপধপে কাপড়ে স্বচ্ছলতার ছাপ স্পষ্ট। তীব্র গরম সহ্য করতে না পেরে রাস্তাতেই অচৈতন্য হয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয়েরা দেখতে পেয়ে তাঁকে সাহায্যের জন্য ছুটে আসেন। মুখে-চোখে জল দিয়ে, খাবার ও জল খাইয়ে সাময়িক ভাবে সুস্থ করেন তাঁরা। কিন্তু তখনও নিজের নাম, পরিচয় কিছুই বলতে পারেননি ওই বৃদ্ধা। শেষে গোলাবাড়ি থানার পুলিশ থানায় নিয়ে আসে তাঁকে। এর পরে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পুলিশকর্মীরাই তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেন হাওড়া জেলা হাসপাতালের ফিমেল সার্জিকাল ওয়ার্ডে।
হাওড়া জেলা হাসপাতাল সূত্রের খবর, ওই বৃদ্ধাকে কয়েক বোতল স্যালাইন দিতে কিছুটা
সুস্থ হয়ে ওঠেন। এর পরেই কাঁদতে কাঁদতে নাতি-নাতনিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাতর আবেদন করতে থাকেন। কিন্তু কোথায় পৌঁছে দিতে হবে, তা প্রথমে বলতে
পারেননি। গোলাবাড়ি থানার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ওই বৃদ্ধাকে বার বার প্রশ্ন করার পরে উনি ‘সালমানপুর’-এর কথা বলেন। আমরা তাই উত্তর প্রদেশের সালমানপুর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু সেখানে বৃদ্ধার বাড়ির কোনও খোঁজ মেলেনি।’’ শেষে পুলিশ যোগাযোগ করে রাজ্যের হ্যাম রেডিয়ো ক্লাবের সঙ্গে। তাদের সাহায্যেই বিহারে খোঁজ মেলে বাঁকা জেলার সালমানপুর গ্রামের। ভিডিয়ো কলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের ছবি দেখানো হয় ওই বৃদ্ধাকে। তখনই পরিজনদের দেখে ফের কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। হ্যাম রেডিয়ো সংগঠনের পক্ষ থেকে অম্বরীশ নাগবিশ্বাস বলেন, ‘‘ওই বৃদ্ধা এক নাতির সঙ্গে গত মাসে মুম্বই গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই নিখোঁজ হন। অনেক চেষ্টা করেও তাঁরা খোঁজ পাননি। কারণ, কোনও ভাবে তিনি হাওড়ায় এসে পৌঁছেছিলেন।’’
বৃদ্ধার পরিবারের লোকজন জানান, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে
ভোটকেন্দ্র হচ্ছে। কিন্তু স্কুলবাড়িটি বর্তমানে ভগ্নপ্রায়। আগামী ২৬ তারিখ সেখানে নির্বাচন। তবে এ বারেই শেষবারের মতো ভোটকেন্দ্র করা হয়েছে ওই স্কুলবাড়িটিতে। কারণ এর পরেই ভেঙে ফেলা হবে সেটি। সে কথা জেনে বাড়িতে থাকাকালীনই উতলা হয়ে উঠেছিলেন ওই বৃদ্ধা। শনিবার হাওড়া জেলা হাসপাতালের ফিমেল সার্জিকালের ৬ নম্বর শয্যায় বসেও তিনি বললেন, ‘‘নাতি-নাতনিরা নিতে আসছে। বাড়ি ফিরে ভোট দিতে যাব। এর পরে আমি আর ভোট দিতে পারব কি না, তা তো জানি না। স্কুলটাই তো ভেঙে দেবে বলছে!’’
প্রায় এক মাস নিখোঁজ থাকার পরে পরিজনদের পেয়ে ৯৫ বছরের বৃদ্ধার একটাই ইচ্ছে—
বাড়ি ফিরে ইভিএমে নিজের ভোটটা দেবেন। গণতন্ত্রের এটাই বড় পাওনা।