Environment

পরিবেশের কথা থাকলেও, ইস্তাহারে দিশা নেই নীতির

তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারে বাংলার পরিবেশের অংশ আলাদা করে জায়গা পেয়েছে। বাংলার বনভূমি বৃদ্ধি, ২০৩২-এর মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত জলাভূমি পুনর্বাসনের কথা বলেছে তারা।

Advertisement

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৪ ০৯:৩৫
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন মানুষ কী ভাবে প্রকৃতির প্রতি ‘অমিতাচারী’। লোকসভা ভোটের শেষ দিকে এসে দেশ ও রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহারে সেই অমিতাচার রোখার কোনও প্রতিফলন রয়েছে বলে মনে করছেন না পরিবেশবিদদের বড় অংশই। তাঁদের মতে, ইস্তাহারে দলগুলি পরিবেশ সংক্রান্ত নানা কথা বললেও, নীতি-রূপায়ণে পরিকল্পনাগত দিশা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

Advertisement

বিজেপির ‘সঙ্কল্প পত্র’ ইস্তাহারে হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় ‘সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি’ এবং দেশের নদী পুনরুজ্জীবন, ‘গ্রিন ক্রেডিট প্রোগ্রামের’ (জিসিপি) পরিধি বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দেশে ‘মৌসম’ নামে একটি প্রকল্প চালুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এগুলি রূপায়ণে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পরিবেশবিদদের একাংশ। তবে ৫০০ গিগাওয়াটের পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন, বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে ‘ব্যাটারি এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ তৈরির কথা বলেছে বিজেপি।

পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির দিকে তাকিয়ে কংগ্রেসও তাদের ‘ন্যায় পত্র’ ইস্তাহারে ‘গ্রিন নিউ ডিল’ শীর্ষক বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। বলা হয়েছে ২০৭০-র মধ্যে ‘নেট-জ়িরো’য় পৌঁছতে রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি ক্ষেত্রকে সঙ্গে নিয়ে ‘গ্রিন ট্রানজ়িশন তহবিল’ তৈরির কথাও। কিন্তু পরিবেশবিদদের মতে, এই তহবিল ও বিনিয়োগের কর্মপন্থা বা ইস্তাহারে নদীগুলি থেকে বর্জ্য নিষ্কাশনের পদ্ধতি নিয়ে ন্যূনতম ইঙ্গিত নেই। তবে পরিবেশ সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত একটি স্বাধীন সংস্থা তৈরি এবং বনাঞ্চলের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ সংশোধিত বন সংরক্ষণ আইন (এফসিএএ, ২০২৩) পর্যালোচনার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা।

Advertisement

সিপিএম-ও এফসিএএ-এর নানা ধারার বিরোধিতা করেছে। আন্দামান ও লক্ষদ্বীপের জন্য পরিবেশগত ভাবে বিপর্যয়কর বাণিজ্যিক পরিকল্পনা, পাম তেল নিয়ে জাতীয় মিশন বাতিল করার কথা বলেছে এই বাম দল। তাদের গঠনমূলক প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে, গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও জলবায়ু বদলের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপশন প্ল্যান’। কিন্তু এই পরিকল্পনাগুলি আদতে কী, তার রূপরেখা নেই ইস্তাহারে।

তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারে বাংলার পরিবেশের অংশ আলাদা করে জায়গা পেয়েছে। বাংলার বনভূমি বৃদ্ধি, ২০৩২-এর মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত জলাভূমি পুনর্বাসনের কথা বলেছে তারা। কিন্তু ‘ক্ষয়প্রাপ্ত বনের পুনর্জন্ম’ ও ‘সবুজ আচ্ছাদন বৃদ্ধি’র কথা বলা হলেও, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ ইস্তাহারে দেখছেন না পরিবেশবিদদের একাংশ। তবে ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ, তথ্য সংগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলেছে তৃণমূল। এফসিএএ-এর বিরোধিতা তারাও করেছে।

সামগ্রিক ভাবে পরিবেশ বিষয়ে নীতি-রূপায়ণের পরিকল্পনাগত ‘অভাব’ ভাবাচ্ছে নীতি-গবেষকদেরও। পরিবেশবিদ তথা নীতি-গবেষক নরশিমা রেড্ডি ডোন্থি বলছেন, “ইস্তাহারগুলির বর্তমান বিষয়বস্তু অন্তত দু’দশক আগে থাকা উচিত ছিল। বর্তমানে, সমস্যা আরও জটিল, যা বাস্তুতন্ত্র, অর্থনীতি এবং জীবিকার সঙ্গে জড়িত। কোনও একটিমাত্র স্বতন্ত্র নীতি ফলাফল দেয় না। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক ছাড়াই রাজনৈতিক দলগুলি সবেমাত্র কিছু ‘পয়েন্ট’ তালিকাভুক্ত করছে।” যদিও রাজনৈতিক দলগুলির সূত্রে পাল্টা ব্যাখ্যা, ইস্তাহার নীতিগত ঘোষণার জায়গা। সেই নীতি রূপায়ণের ব্যবস্থা কী ভাবে হবে, তা অন্য প্রসঙ্গ।

পরিবেশের প্রসঙ্গ উঠলে, তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত জনজাতি জীবনের কথাও আসে। এই সূত্রেই বন অধিকার আইনের (এফআরএ, ২০০৬) অধীনে আধিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছে কংগ্রেস ও সিপিএম। আদিবাসীদের ‘বন পরিচালনার’ অধিকারের কথা বলেছে তৃণমূল। বিজেপি জোর দিয়েছে আদিবাসী সংস্কৃতির সংরক্ষণের মতো বিষয়ে। কিন্তু এই সব ‘অল্প কথা’য় সামগ্রিক জনজীবনের প্রসঙ্গ কতটা রয়েছে, তা নিয়ে সন্দিহান পরিবেশবিদেরা। পরিবেশ আন্দোলনের প্রবীণ কর্মী নব দত্তের কথায়, “নির্বাচনে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি গরিব মানুষের কথা বলে। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রচণ্ড দাবদাহের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমাজ জীবনে পরিবেশ বিপর্যয়ের গুরুত্ব ও প্রভাব কী, তা নিয়ে যথোপযুক্ত কথা তাদের ইস্তাহারে জায়গা পায় না।”

ভোটের আবহে চর্চা হচ্ছে, প্রচারে প্রার্থীরা এবং দলগুলি পরিবেশের কথা কতটা বলছেন, প্রচার সামগ্রীই কতটা পরিবেশবান্ধব। রাজ্যে সিপিএমের সায়রা শাহ হালিম বা দীপ্সিতা ধরদের মতো কয়েক জন প্রার্থীর মুখে পরিবেশ নিয়ে কিছু কথা শোনা গেলেও তা যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছেন পরিবেশবিদেরা। মূলত কলকাতাভিত্তিক একটি সমীক্ষা করে পরিবেশবিজ্ঞানী স্বাতী নন্দী চক্রবর্তীর অভিজ্ঞতা, “সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মানুষ যতটা পরিবেশের কথা শুনতে চাইছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি তা বলছে না। সেই সঙ্গে, প্রচারে পরিবেশবান্ধব সামগ্রীও ব্যবহার করা হচ্ছে না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement