অবৈধ: বর্জ্য ফেলে বুজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বালিটিকুরির বকুলতলা রামকৃষ্ণ পল্লীর রেনীর পুকুর। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
প্রথম ধাপে আবর্জনা ফেলে ধীরে ধীরে ব্যবহারের অযোগ্য করে তোলা হয় পুকুরের জল। দ্বিতীয় ধাপে সেই পুকুরের একটি নির্দিষ্ট কোণ থেকে আবর্জনা বা মাটি ফেলে বোজানোর কাজ শুরু হয়। মূলত এই পদ্ধতিতেই হাওড়া জুড়ে চলছে একের পর এক পুকুর বুজিয়ে বহুতল তৈরির কাজ। লোকসভা ভোটের আগে সেই কাজ যেন আরও গতি পেয়েছে।
শুধু কলকাতার গার্ডেনরিচে নয়, হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের পাঁচলা থেকে শহর হাওড়ায় জলাভূমি বুজিয়ে অবাধে এই মারণ-ব্যবসা চললেও প্রশাসনের কোনও হুঁশ নেই বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু প্রোমোটারের তৈরি করা সিন্ডিকেটের হাত ধরে বিভিন্ন এলাকায় জন্ম নিয়েছে সন্দেশখালির শেখ শাহজাহানের মতো এক-এক জন ‘বাহুবলী’। ভোট আসতেই তারা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের তোলা কোটি কোটি টাকা সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতা ও দলের হাতে। সেই টাকাই খরচ হচ্ছে ভোটের কাজে।
অভিযোগ, জলাজমি ভরাট করার এই সিন্ডিকেট চক্রের থাবা বসেছে হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের শিবপুর, দক্ষিণ হাওড়া, মধ্য হাওড়া, উত্তর হাওড়া থেকে সাঁকরাইল ও পাঁচলা বিধানসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। হাওড়া পুরসভার তথ্য বলছে, কার্যত জমি-মাফিয়াদের সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হয়ে দাঁড়িয়েছে শিবপুর বিধানসভা কেন্দ্র। কারণ, গত এক বছরে চারটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে যেখানে মোট ৪৮টি পুকুর বোজানোর অভিযোগ পুরসভায় জমা পড়েছে, তার মধ্যে ২৫টি অভিযোগই এসেছে শুধু শিবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। পুকুর বোজানোর দৌড়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মধ্য হাওড়া। গত এক বছরে সেখানে ১১টি পুকুর বোজানোর অভিযোগ উঠেছে। এক বছরে ১০টি পুকুর বোজানোর অভিযোগ এসেছে দক্ষিণ হাওড়া থেকে। আর মাত্র দু’টি অভিযোগ উত্তর হাওড়া থেকে।
কিন্তু কতটা বেপরোয়া জলাজমি ভরাটের এই সিন্ডিকেট চক্র?
শিবপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বালিটিকুরি এলাকার বাসিন্দা অসিত চক্রবর্তী জানান, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বালিটিকুরি বকুলতলা রামকৃষ্ণপল্লি জেল গেটের কাছে প্রায় ৬০ কাঠা এলাকা জুড়ে রয়েছে রেনির পুকুর। এলাকার পাঁচ হাজার মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করেন এই পুকুরটি। শুধু তা-ই নয়, বর্ষায় এলাকায় জলধারণ করে একমাত্র এই পুকুরটিই। অসিতের অভিযোগ, ‘‘সম্প্রতি এলাকার কিছু কুখ্যাত সমাজবিরোধীকে নিয়ে তৈরি সিন্ডিকেট বাহিনী দিনের বেলায় প্রকাশ্যে এই পুকুরটি ভরাট করছে। কেউ প্রতিবাদ করলে সরাসরি বাইকবাহিনী এসে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে খুনের হুমকি দিচ্ছে। এরাই আবার শাসকদলের প্রার্থীর হয়ে এলাকায় ভোটের প্রচারও করছে।’’
জলাজমি ভরাটের অভিযোগ যে প্রতিনিয়ত পুরসভায় আসছে, তা মানছেন হাওড়া পুরসভার চেয়ারম্যান সুজয় চক্রবর্তীও। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য, ‘‘কিছু লোকের মদতে এই অবৈধ কাজ চলছে। আমাদের লোকবল যে হেতু কম, তাই অভিযোগ পেলে পুরসভার ‘জল ভরো, জল ধরো’ দফতরের কর্মীরা গিয়ে কয়েকটি পুকুর থেকে মাটি তুলে সংস্কার করেছেন। আমি শিবপুর বিধানসভা কেন্দ্রে গিয়ে দু’টি পুকুর বোজানোর চেষ্টা বন্ধ করেছি। তবু জলাশয় বোজানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’’
জলাজমি ভরাটের এই সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্য শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে যে আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে, তা বোঝা গেল পাঁচলা বিধানসভা কেন্দ্রের জুজারসাহা সরকারপাড়ায় গিয়ে। সেখানে চার দিকে ভোটের দেওয়াল লিখন। বেশির ভাগই শাসকদল তৃণমূলের প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দু’-একটি দেওয়াল রয়েছে বিজেপির রথীন চক্রবর্তীর নামে। চোখে পড়েনি সিপিএম প্রার্থীর নামে কোনও দেওয়াল লিখন। সেখানে পিচ রাস্তা ছাড়িয়ে সঙ্কীর্ণ পথ ধরে মিনিট দশেক গ্রামের দিকে গেলেই দেখা মিলবে একটি টলটলে দিঘির। এই দিঘির জন্যই এলাকার নাম দিঘির পাড়। সারা বছর এই দিঘির জল থেকেই আশপাশের গ্রামের চাষাবাদ হয়। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এলাকায় শেখ শাহজাহানের মতো ‘বাহুবলী’ হয়ে ওঠা তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত সভাপতির মদতে চাষের জলের একমাত্র উৎস ওই দিঘিটিকেই লরি লরি ছাই-মাটি ফেলে বোজানো শুরু হয়েছে তেলকল করার জন্য। এর সক্রিয় প্রতিবাদ করেছিলেন গ্রামের মানুষ। তার পরিণতিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে কয়েকশো সশস্ত্র দুষ্কৃতী গ্রামের মহিলাদের বাড়ি থেকে টেনে এনে যৌন হেনস্থা, লাঠি, রড দিয়ে মারধর, বাড়ি ভাঙচুর— কোনও কিছু করতে বাদ দেয়নি। ফিরে যাওয়ার সময়ে তারা হুমকি দিয়ে গিয়েছিল, পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে সবাইকে পুলিশ দিয়েই মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে।
ওই ঘটনার পরের দিন সমস্ত গ্রামের মহিলারা এক হয়েছিলেন, সন্দেশখালির মহিলাদের মতোই। লাঠি নিয়ে রুখে দাঁড়ান দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। অবরোধ করেন রাস্তা। পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে দাবি করেন, দিঘিতে ফেলা মাটি খুঁড়ে তুলে দিতে হবে, গ্রেফতার করতে হবে দুষ্কৃতীদের। যদিও গ্রামবাসীদের দাবিমতো কোনও কিছুই হয়নি। এলাকায় অবাধে শাসকদলের প্রার্থীর হয়ে ভোট-প্রচারে নেমে পড়েছে আক্রমণকারীরা।
তখনকার মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও ওই ঘটনার এক মাস পরেও আতঙ্ক কাটেনি। সেই দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘোমটায় মুখ ঢেকে সে দিনের প্রতিবাদী এক মহিলা বললেন, ‘‘আতঙ্কে রাতের ঘুম চলে গিয়েছে। বাড়ির ছেলেরা ঘরছাড়া। আমরা রাত জেগে এখনও ওই দিঘি পাহারা দিচ্ছি। ভোট মিটে গেলেই ওরা ফের আক্রমণ করবে। জানি না, আটকাতে পারব কি না।’’ গ্রামের মহিলাদের এই প্রতিরোধ আর কত দিন টিকবে, সেই প্রশ্নের উত্তর রয়ে গিয়েছে ভবিষ্যতের গর্ভে।