অমৃতা রায়। —ফাইল চিত্র।
ভোটে হারের পরেই পদ্মে ‘বিমুখ’ কৃষ্ণনগর রাজবা়ড়ির বধূ অমৃতা রায়! পরাজয়ের দায় কার্যত দলীয় নেতৃত্বের একাংশের ঘাড়ে চাপিয়ে তাঁর বক্তব্য, অন্যের কথা শুনে ‘ভুল হয়েছে’! নিজের পরিকল্পনা মতো চললে ভোটে আরও ভাল ফল করতেন। দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে ভাবে সরব হয়েছেন অমৃতা, তাতে প্রশ্ন উঠেছে, এর পরেও কি তিনি রাজনীতিতে থাকবেন? শুক্রবার সকালে আনন্দবাজার অনলাইনকে অমৃতার সপাট জবাব, ‘‘এর পরে যদি রাজনীতি করি, নিজের বুদ্ধিতেই চলব! অন্যের কথায় নয়!’’
কৃষ্ণনগরে তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অমৃতাকে প্রার্থী করে ‘চমক’ দিয়েছিল বিজেপি। প্রার্থী ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই প্রচারে বেরিয়ে বহু এলাকায় গিয়েছিলেন রাজবধূ। দু’বার তাঁর কেন্দ্রে প্রচারে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদীও। যেমন প্রচারে গিয়েছিলেন অমিত শাহও। মোদী তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। তা ধুমধাম করে প্রচারও করেছিল বিজেপি। কিন্তু কৃষ্ণনগরের ফলাফল বদলায়নি। মহুয়ার কাছে প্রায় ৫৭ হাজার ভোটে হারতে হয়েছে অমৃতাকে।
ভোটে পরাজয়ের পরেই দলের একাংশের বিরুদ্ধে মুখ খুলে আনন্দবাজার অনলাইনকে অমৃতা বলেছেন, ‘‘এই পরাজয় মানতে পারছি না। ওরা যেমন বলেছে, তেমনই করেছি। আমি তো রাজনীতিতে নতুন। সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রচার করেছি। যেখানে বলেছে, সেখানে গিয়েছি। অন্যের বুদ্ধিতে চলেছি। নিজের বুদ্ধিতে চললে এর চেয়ে ভাল ফল করতাম।’’
এক ধাপ এগিয়ে অমৃতার ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, রাজবধূকে ‘ডুবিয়েছেন’ তাঁর ভোটপ্রচারের দায়িত্বে থাকা নেতারা। তাঁরা ‘দুর্নীতি’ করেছেন। প্রচারের জন্য আসা অর্থ সরিয়েছেন। অমৃতার এক ছায়াসঙ্গী শুক্রবার বলেন, ‘‘রানিমার কথায় কেউ কান দেননি। রানিমা চোখের সামনে দেখেছেন দুর্নীতি হচ্ছে! উনি সে কথা বলেওছেন। কিন্তু ওঁর কথা শোনা হয়নি। উল্টে এখানকার (নদিয়া এবং কৃষ্ণনগরের) নেতৃত্ব যা বলেছেন, তা-ই করতে হয়েছে। রানিমা যদি নিজের বুদ্ধিতে চলতেন, তা হলে হারতেন না।’’
কৃষ্ণনগরে প্রার্থীবাছাই নিয়ে বিজেপির অন্দরে অনেক জলঘোলা হয়েছিল। কৃষ্ণনগরের প্রাক্তন সাংসদ, প্রয়াত সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় ওরফে জলুবাবুর ছেলে সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে প্রার্থী করার জন্য একাংশ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি শারীরিক কারণে ভোটে দাঁড়ানোর ধকল নিতে রাজি হননি। তার পরে সম্ভাব্য প্রার্থিতালিকায় ঝুলন গোস্বামী, সোমা বিশ্বাসের মতো জাতীয় স্তরের ক্রীড়াবিদের নাম নিয়েও পর্যালোচনা চলেছিল। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর অমৃতাকে ওই আসনে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। যুক্তি ছিল, রাজবধূকে ভোটারদের কাছে নতুন করে পরিচয় করাতে হবে না। তাঁকে সকলেই একডাকে চেনেন। অমৃতার ওই ঘনিষ্ঠ দাবি করেন, রাজবধূর ভাবমূর্তি ও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নামকে ‘ব্যবহার’ করেছে বিজেপি। রাজপরিবারকেও ঠকানো হয়েছে। ওই ঘনিষ্ঠের কথায়, ‘‘বিজেপি ঠকিয়েছে রানিমাকে! রানিমার ইমেজ, রাজবাড়ির নামে রানিমাকে রাস্তায় নামিয়েছে! রানিমাও ঘুরেছেন। কিন্তু এখানে বিজেপি নেতারা নিজেরা দুর্নীতি করেছেন। মোদীজি-শাহজির সভায় চুরি হয়েছে। বার বার হিসাব চাওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ হিসাব দেয়নি। সই করিয়ে চেকবুক নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পাশবইও রানিমার কাছে ছিল না।’’
অমৃতার ঘনিষ্ঠমহলের আরও দাবি, টাকাপয়সা সরানোর বিষয়টি বিজেপি নেতা অমিত মালবীয় এবং রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি। রাজবধূর এক ছায়াসঙ্গী বলেন, ‘‘যারা টাকাপয়সা সরিয়েছে, তাদের নামের তালিকা বানানো হচ্ছে। বিষয়টি নেতৃত্বকে জানানো হবে।’’
ভোটপ্রচারে বিজেপির নেতারা অমৃতাকে ‘রাজমাতা’ ও ‘রানিমা’ হিসাবে পরিচয় দেওয়ায় জোর বিতর্ক হয়েছিল। ‘রাজমাতা’ শব্দটি নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ‘কোথাকার রাজমাতা?’— এই প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, এই দেশে এখন আর কেউ ‘রাজা’ নেই, সকলেই ‘প্রজা’! সেই সঙ্গে পলাশির যুদ্ধে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ভূমিকা অর্থাৎ, সিরাজ-উদ-দৌলার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশকে সমর্থন করা নিয়ে অমৃতা নিজেই যে কথা বলেছিলেন, তা নিয়েও জোর বিতর্ক হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। ভোটে হারের পর রাজপরিবারের একাংশের দাবি, ভোট-রাজনীতিতে না নামলে হয়তো এই পরিস্থিতিই তৈরি হত না। শুধুমাত্র পুজোর সময় ছাড়া রাজবাড়ির পাঁচিলের ও পারের জগৎ এত কাল কৃষ্ণনগরবাসীর ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল। বিজয়া দশমীর সিঁদুরখেলায় অমৃতাকে কিছুটা কাছাকাছি পাওয়া যেত। লোকের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল বলেই রাজপরিবারের গরিমা অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু ভোটের সময় রাজবাড়ির ইতিহাস ও ‘রানিমা’ আখ্যা নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছে, তাতে রাজপরিবারের নাম খানিকটা হলেও খারাপ হয়েছে বলেই মনে করছে অমৃতার ঘনিষ্ঠমহল। তাঁর ছায়াসঙ্গীর কথায়, ‘‘এ সব কারণে রাজনীতি থেকে মন উঠতে শুরু করেছে রানিমার!’’ অমৃতা নিজেও বলেছেন, ‘‘রাজনীতি করলে নিজের বুদ্ধিতেই করব। এ বার কলকাতা যাব। সব কিছু ঠিকঠাক হলে সকলের সঙ্গে কথা বলব।’’