(বাঁ দিক থেকে) কুণাল ঘোষ, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস রায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শুক্র এবং শনিবার বল বাড়িয়েছিলেন কুণাল ঘোষ। শনিবারেই কুণালের বাড়ানো বল ধরে গোলের দিকে এগোতে শুরু করেছেন তাপস রায়। লক্ষ্য সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার তাপস বল ছাড়লেন সতীর্থ কুণালকে উদ্দেশ্য করে। সেই বল ধরে ফের কুণাল নিখুঁত মাইনাস রাখার চেষ্টা করলেন। উদ্দেশ্য একটাই, ভোটের মাঠ থেকে সুদীপকে সাইডলাইনে ছিটকে দেওয়া।
কিন্তু কুণাল-তাপস যে ভাবে নিজেদের মধ্যে ইয়োরোপীয় ধাঁচে ‘ওয়ান টাচ ওয়াল’ খেললেন, সেই বল ‘ডি বক্সে’ ঢুকে তৃণমূলের জালেই জড়িয়ে যাবে না তো? সেমসাইড গোলের সেই আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে শাসক শিবিরের অন্দরে। পাশাপাশি কৌতূহল এ-ও যে, ক্যাপ্টেনের কি সেমসাইডের ভয় নেই? তিনি কি দেখছেন না? প্রসঙ্গত, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ নেতারা ঘরোয়া পরিসরে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে অভিহিত করেন। ঘটনাচক্রে, তাপস-কুণাল দু’জনেই দলে অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত।
যদিও সুদীপ এই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সম্পূর্ণ নীরব। তাঁকে ফোন করা হলেও জবাব মেলেনি। উত্তর আসেনি মোবাইলে পাঠানো বার্তারও। তবে গোটা বিষয়টিই তিনি দলীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছেন এবং দলের শীর্ষনেতৃত্বকে অবহিত রেখেছেন বলে খবর।
দলের প্রবীণ সাংসদ সুদীপকে লক্ষ্য করে কুণাল তোপ দাগা শুরু করেছিলেন বৃহস্পতিবার রাত থেকে। শুক্রবার এক ধাপ এগিয়ে তিনি নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) বায়ো থেকে তৃণমূলের মুখপাত্র এবং রাজ্য সম্পাদকের পরিচয় মুছে দেন। কিন্তু একইসঙ্গে জানিয়ে দেন, তিনি দলেই থাকছেন। তার পর থেকেই লাগাতার সুদীপকে আক্রমণ করতে শুরু করেন কুণাল। শনিবার সকালে তিনি একদিকে যেমন ব্রিগেডের প্রস্তুতি মিছিলে অংশ নেন, তেমনই অন্যদিকে সুদীপের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি নিয়ে সরাসরি তদন্তের দাবি তোলেন। এক (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে সেই পোস্টে তিনি ট্যাগ করে দেন ইডির ডিরেক্টর এবং সিবিআইকে। এমনকি, সেই তদন্ত শুরু না হলে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন। লক্ষ্য একটাই— সুদীপ যাতে উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী না-হন।
তবে পাশাপাশিই কুণাল জানিয়েছেন, এত সবের পরেও দল যদি সুদীপকে উত্তর কলকাতায় প্রার্থী করে, তা হলে দলের কর্মী এবং সৈনিক হিসেবে তিনি তা মেনে নেবেন এবং দলের স্বার্থে সুদীপকে জেতাতেও মাঠে নামবেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা সবাই দলের সৈনিক। প্রার্থী ঘোষণা হয়ে গেলে তিনি যে-ই হোন, তাঁর জন্যই নামতে হবে।’’ তবে তাপস জানিয়েছেন, সুদীপ দাঁড়ালে তিনি নির্বাচনে কাজ করবেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘২০০৯ আর ২০১৪ সালে ওর (সুদীপের) ইলেকশনে ম্যানেজারি করেছি। ২০১৯-এ করিনি। ছেলেদের চাপে তিনটে মিটিং করেছিলাম। এ বার করব না।’’
তবে সে সব অনেক পরের কথা। আপাতত ঘরের কোন্দলে তৃণমূল সরগরম। শনিবার কুণালের পরেই ময়দানে নামেন তৃণমূলের প্রবীণ বিধায়ক তাপস। বরাহনগরের তৃণমূল বিধায়ক শনিবার দুপুরে বলেন, ‘‘এ বার উত্তর কলকাতায় প্রার্থী হলে সুদীপ গোহারা হারবেন।’’ তার অব্যবহিত পরেই কুণাল বলেন, ‘‘উত্তর কলকাতা কখনও মহিলা সাংসদ পায়নি। এখানে শশী পাঁজার মতো দক্ষ মন্ত্রী রয়েছেন। তাঁকে প্রার্থী করা যেতেই পারে।’’ কিন্তু সুদীপের স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো মহিলা। তাঁকেও তো প্রার্থী করা যেতে পারে। কুণালের জবাব, ‘‘সে উনি ওঁর বিউটি পার্লার-টার্লার সামলে সময় দিতে পারলে আমাদের আপত্তি নেই।’’ আবার তাপসের কথায়, ‘‘কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের জন্য আমার নামটা নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন থেকেই ও আমার পিছনে লেগেছে। তাঁর বাড়িতে ইডি পাঠিয়ে দিয়ে তাঁকে কলুষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। দল আমাদের মতো লোককে বরাহনগরে পাঠাবে আর প্রার্থী করবে সোমেন মিত্রের বউ, সুদীপের বউকে।’’ প্রসঙ্গত, অধুনাপ্রয়াত সোমেনের স্ত্রী শিখা মিত্র তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন। সুদীপের স্ত্রী নয়না এখনও তৃণমূলের বিধায়ক।
সুদীপ-তাপস প্রকাশ্য বাগ্যুদ্ধের ইতিহাস দীর্ঘ। শনিবার তাপস তাঁর বাড়িতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হানা নিয়েও আঙুল তুলেছেন সুদীপের দিকে। গত ১২ জানুয়ারি তাপসের মধ্য কলকাতার বাড়িতে হানা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তাপসের দাবি, সুদীপই তাঁর বাড়িতে ইডিকে ঢুকিয়েছিলেন! কেন এই দাবি করছেন তাপস? জবাবে বরাহনগরের বিধায়ক বলেছেন, ‘‘ওর ইডির কিছু লোকজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে ভাল সম্পর্ক আছে। আমায় তৃণমূলের রাজ্যসভা, লোকসভার সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী, নেতা মিলিয়ে অন্তত ৫০ জন বলেছেন, ও-ই ইডিকে পাঠিয়েছিল! আমার বাড়িতে কবে ইডি যাবে, তা ওর বাড়িতে আলোচনা হয়েছিল। তার পরে ওরা উৎসবও করেছিল।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সুদীপের কাজই হল ভাল ছেলেদের কাঠি করা।’’
সেই প্রসঙ্গেই সুদীপের সঙ্গে ‘বিজেপি যোগের’ অভিযোগ তোলেন তাপস। যা শুক্রবার বলেছিলেন কুণালও। তাপসের কথায়, ‘‘কেউ কেউ তৃণমূলে আছে। দলে থেকে খাচ্ছে, পরছে, সব উপভোগ করছে। তার পরে অন্য দলকে খবর পাচার করছে। সুদীপও সেই রকম।’’ তাপসের অভিযোগ, সুদীপ যে বিজেপির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখেন, তা তিনি গর্ব করে বলেনও।