জাল আরও গোটাল সিবিআই, এ বার গ্রেফতার মদন

সারদা কাণ্ডে এ বার আক্ষরিক অর্থেই মাথায় টান দিল সিবিআই! সিবিআই জেরার প্রথম দিনেই গ্রেফতার হলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। শুক্রবার টানা পাঁচ ঘণ্টা জেরার পরে সিবিআই তাঁকে গ্রেফতার করল। সিবিআইয়ের একটি সূত্রের খবর, তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের সদুত্তর দিচ্ছিলেন না, বহু প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকী, প্রমাণ দেখানোর পরেও তিনি তা অস্বীকার করেন বলে ওই সূত্রের দাবি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁদের হয়ে খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে সওয়াল করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ, সাংসদ সৃঞ্জয় বসুর (টুম্পাই) পর এ বার সিবিআইয়ের জালে ধরা পড়লেন মন্ত্রী মদন মিত্র।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৯:৪৫
Share:

গ্রেফতারির পর মদন মিত্রকে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: শৌভিক দে।

সারদা কাণ্ডে এ বার আক্ষরিক অর্থেই মাথায় টান দিল সিবিআই! সিবিআই জেরার প্রথম দিনেই গ্রেফতার হলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র।

Advertisement

শুক্রবার টানা পাঁচ ঘণ্টা জেরার পরে সিবিআই তাঁকে গ্রেফতার করল। সিবিআইয়ের একটি সূত্রের খবর, তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের সদুত্তর দিচ্ছিলেন না, বহু প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকী, প্রমাণ দেখানোর পরেও তিনি তা অস্বীকার করেন বলে ওই সূত্রের দাবি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁদের হয়ে খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে সওয়াল করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ, সাংসদ সৃঞ্জয় বসুর (টুম্পাই) পর এ বার সিবিআইয়ের জালে ধরা পড়লেন মন্ত্রী মদন মিত্র। মদনের পাশাপাশি এ দিনই সিবিআই গ্রেফতার করেছে সুদীপ্ত সেনের আইনজীবী নরেশ ভালোটিয়াকে। সূত্রের খবর, শনিবার এঁদের দু’জনকেই আদালতে পেশ করে নিজেদের হেফাজতে চাইবে সিবিআই। এ দিন রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ মদনবাবুকে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বের করে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্নীতির অভিযোগে এই রাজ্যে কোনও মন্ত্রীকে গ্রেফতার করাটা কার্যত নজিরবিহীন।

যদিও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন স্পষ্ট ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, সরকার ও দল মদনের পাশেই আছে। সন্ধ্যায় নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “মদনই পরিবহণমন্ত্রী থাকবে। আমি ওকে সরাবো না। ও যাওয়ার আগে আমায় পদত্যাগপত্র দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি ওটা গ্রহণ করছি না।” সিবিআই মদনকে ডাকবেই, এই খবর জানার পর থেকে প্রকাশ্যে পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছিলেন মমতা। যদিও তাঁর গ্রেফতারির পরে এ দিন মমতার মন্তব্য, “মদন খেলা ভালবাসে, সংস্কৃতি ভালবাসে। যে দিন থেকে সারদা চিট ফান্ড হিসাবে ঘোষিত হয়েছে, তার পর থেকে ও কি সারদার কোনও অনুষ্ঠানে থেকেছে? ও অনেকের উপকার করেছে। ওর অ্যাজমা আছে, হার্টেরও সমস্যা আছে। আমি শুনলাম, ওকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি ওকে দেখতে যাব। দেখি নরেন্দ্র মোদীর কত পুলিশ আছে, কত গুন্ডা আছে। পারলে আমায় গ্রেফতার করে দেখাক। চ্যালেঞ্জ রইল।” কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে মমতা বলেন: “এই বিজেপি সরকার কাপুরুষ। গণতন্ত্র ভাঙার এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছে তারা। ওরা অটোক্র্যাট হিসাবে দেশটাকে বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিজেপি সরকার সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”

Advertisement

কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার পরে কি কাউকে মন্ত্রী রাখা যায়?

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এ ব্যাপারে আইনগত কোনও বাধা নেই। যত ক্ষণ না তিনি দোষী প্রমাণিত হচ্ছেন, তত ক্ষণ তিনি মন্ত্রী পদে থাকতেই পারেন। তবে, আইনগত বাধা না থাকলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রী পদে রেখে দেওয়াটা নৈতিকতার প্রশ্ন বলে তাঁদের মত।

এই গ্রেফতারির পরেই নবান্নে সাংবাদিকদের কাছে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় সরাসরি জানিয়ে দেন, মদন মিত্রের গ্রেফতারি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁরা রাজনৈতিক ভাবেই এর মোকাবিলা করবেন। তাঁর কথায়: “সরকার জানল না, স্পিকার জানলেন না, অথচ এক মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হল। এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। বিজেপি সরকার গায়ের জোর দেখিয়ে এটা করছে। অমিত শাহের সভার পর থেকেই আমরা আশঙ্কা করেছিলাম এ রকম কিছু ঘটতে পারে। আইনের সব দিক দেখে আমরা দরকারে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব আনব।” শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, মদনের গ্রেফতারির প্রতিবাদে ধর্মতলায় গোষ্ঠ পালের মুর্তির পাদদেশ থেকে আগামিকাল মিছিল বের হবে। ধর্মতলা চত্বরেই শেষ হবে মিছিল। মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে খেলোয়াড়-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষকে। মমতাও পরে জানান, সুব্রতবাবু এবং পার্থবাবুর ওই বক্তব্যই দলের অবস্থান।

এর আগে প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন: “কুণাল চোর? টুম্পাই চোর? মদন চোর? মুকুল চোর? আমি চোর?” সুপ্রিম কোর্টের আদেশে সারদা মামলার তদন্তভার সিবিআই নেওয়ার পর থেকে গ্রেফতার হন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় (টুম্পাই) বসু। এ দিন গ্রেফতার হলেন মদন মিত্র। এরই মধ্যে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত (নীতু) সরকার, রাজ্যের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল তথা দলীয় নেতা রজত মজুমদার। যদিও আগেই বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন বহিষ্কৃত তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ।

গত এক মাস ধরে সিবিআইয়ের বাউন্সার ‘ডাক’ করতে করতে অবশেষে এ দিন তা খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজ্যের পরিবণমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা মদন মিত্র। শুক্রবার বেলা ১০টা ৫৫ মিনিট নাগাদ আইনজীবীকে নিয়ে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে এসে পৌঁছন তিনি। সিজিও কমপ্লেক্সের বাইরে তখন মোটামুটি ব্যূহ রচনা করে ফেলেছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। অপেক্ষারত সাংবাদিকদের তাঁর কাছাকাছি পৌঁছতেও দেওয়া হয়নি।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে ‘মাথার খোঁজে’ সিবিআই বেশ কয়েক বার ডেকে পাঠিয়েছে মদন মিত্রকে। কিন্তু ‘আতঙ্কগ্রস্ত’ মন্ত্রী বার বার এড়িয়ে গিয়েছেন সেই ডাক। জেরা থেকে ‘বাঁচতে’ মিন্টো পার্কের এক বেসরকারি হাসপাতালের ‘শরণাপন্ন’ হন মন্ত্রী। দিন পঁচিশেক সেখানে কাটিয়ে মেডিক্যাল বোর্ডের প্রয়োজনীয়তা ‘অনুভব’ করে নিজেই চলে আসেন রাজ্যের একমাত্র সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমে। ভর্তি হন উডবার্ন ওয়ার্ডে। ইতিমধ্যেই এসে যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভয়বাণী, চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকেন মন্ত্রী। দুই হাসপাতাল মিলিয়ে মাসাধিককাল কাটিয়ে বাড়ি ফিরে মদন জানান, সিবিআই জেরার জন্য তৈরি তিনি। সেই মতো চলতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার তাঁকে ডেকে পাঠায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি। কিন্তু কিছু পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি থাকায় সিবিআই-কে অনুরোধ করে বাড়তি ২৪ ঘণ্টা সময় চেয়ে নেন মদন। এ দিনও তিনি আসবেন কি না তা নিয়ে ছিল জল্পনা। অবশেষে তিনি এলেন। মুখোমুখি হলেন জেরার। এবং প্রথম দিনেই গ্রেফতারও হলেন।

কিন্তু এ দিন সিবিআই দফতরে যাওয়া নিয়ে এক প্রস্থ নাটক হয় মদনবাবুর ভবানীপুরের বাড়ির বাইরে। এ দিন সকাল থেকেই তাঁর বাড়ির বাইরে ছিল সংবাদমাধ্যমের ভিড়। ছিলেন তৃণমূলের বহু কর্মী এবং পরিবহণমন্ত্রীর দেহরক্ষীও। মোটরবাইক নিয়ে কয়েক জন যুবককেও দেখা যায় বাড়ির বাইরে। বার বারই বলা হতে থাকে, “আর কিছু ক্ষণ পরেই দাদা রওনা দেবেন।” স্বভাবতই ধরে নেওয়া হয় মদনবাবু এই বাড়ি থেকেই বেরিয়ে সিবিআই দফতরে যাবেন। কিন্তু সেই ‘কিছু ক্ষণ’ অপেক্ষা শেষ হওয়ার আগেই বেলা ১১টা নাগাদ অপেক্ষারত সাংবাদিকদের কাছে খবর আসে, সিজিও কমপ্লেক্সে পৌঁছে গিয়েছেন ‘দাদা’। মদন-অনুগতদের মুখে তখন বিজয়ীর হাসি।

কিছু দিন আগেই তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকে সাক্ষী হিসাবে ডেকে গ্রেফতার করে সিবিআই। মদনকেও ডাকা হয়েছিল সাক্ষী হিসাবেই। গ্রেফতারির জল্পনা বাড়িয়ে দেন মন্ত্রী নিজেই। গাঁধী-সুভাষ-নেহরুও জেলে গেছেন বলে কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করেন তিনি। প্রশ্ন ছিল, মন্ত্রীকে কি আজই গ্রেফতার করা হবে? উত্তরও মিলে গেল এ দিন বিকেল ৪টে ২০ মিনিটে।

ছবি: শৌভিক দে।

যে পথে সিবিআই তদন্ত

২৩ এপ্রিল, ২০১৩

সুদীপ্ত সেন এবং তাঁর দুই ছায়াসঙ্গী দেবযানী মুখোপাধ্যায় এবং অরবিন্দ সিংহ
চৌহানকে সোনমার্গের একটি হোটেল থেকে গ্রেফতার করে কাশ্মীর পুলিশ।

২৩ নভেম্বর, ২০১৩

সারদা কাণ্ডে গ্রেফতার করা হল বহিষ্কৃত তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষকে।

২০ অগস্ট, ২০১৪

গ্রেফতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু।

৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

গ্রেফতার প্রাক্তন পুলিশকর্তা তথা তৃণমূল নেতা রজত মজুমদার। গ্রেফতার করার আগে
সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সের সিবিআই অফিসে টানা তিন ঘণ্টা জেরা করা হয় তাঁকে।

২১ নভেম্বর ২০১৪

দীর্ঘ ছ’ঘণ্টা জেরার পরে গ্রেফতার তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু ওরফে টুম্পাই।

১২ ডিসেম্বর ২০১৪

দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা জেরার পরে গ্রেফতার পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement