শহিদ সমাবেশের মঞ্চে তখন মমতা।
একুশে জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে দলের শৃঙ্খলারক্ষায় ফের কড়া বার্তা দিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা নির্বাচনে এ বার রাজ্যে নজিরবিহীন সাফল্য পেয়ে ৩৪টি আসন ঘরে তুলেছে তৃণমূল। এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে সিন্ডিকেট নিয়ে গোষ্ঠী সংঘর্ষ, তোলা আদায়ের অভিযোগ ঘিরে বিশৃঙ্খলা বা শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের ঘটনা বেশি করে সামনে আসছে। লোকসভা নির্বাচনের পর এর আগে কোনও বড় সমাবেশ করেননি তৃণমূল নেত্রী। সেই জন্য সোমবার ধর্মতলার মঞ্চকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন বার্তা দেওয়ার জন্য।
দলের শহিদ সমাবেশের মঞ্চ থেকে এ দিন মমতা বলেন, “আমাদের সকলকে কাজ করতে হবে উন্নয়নের জন্য। বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আপনারা বলুন, আমরা অন্যায় করব না। অন্যায় করতে দেব না। অন্যায় হচ্ছে দেখলে আমি কিন্তু ব্যবস্থা নেব।” এই সঙ্গেই তৃণমৃূল নেত্রী জোর গলায় ফের জানিয়েছেন, টাকা দিয়ে বা লবি করে তাঁদের দলে নেতা হওয়া যায় না। তাঁর কথায়: “টাকা দিয়ে তৃণমূল টিকিট বিক্রি করে না। নেতা হওয়ার জন্য এখানে টাকা লাগে না। লবি করতে হয় না। কেউ ভাবল, লবি করব, নেতা হব বলে বক্তৃতা করব, তাতে কিছু হবে না।”
সাম্প্রতিক কালে একের পর এক ঘটনায় শাসক দলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগের আঙুল উঠছে, তা অবশ্য মাথায় ছিল মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সে কারণে প্রায় আধ ঘণ্টার ভাষণে আগাগোড়া তিনি এ দিন বলে গিয়েছেন, তাঁদের দলের বিরুদ্ধে কুত্সা, অপপ্রচার চলছে। সে সব উপেক্ষা করেই মানুষ লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু তৃণমূল কর্মীদেরও অবশ্যকর্তব্য, কাজে-কর্মে-আচরণে সতর্ক থেকে নিজেদের জনভিত্তি দুর্বল হতে না দেওয়া। সম্প্রতি জামুড়িয়ায় শ্যাম সেল গোষ্ঠীর অফিসারদের হুমকি দেওয়া এবং তাঁদের কাছে তোলা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। শুধু এই ঘটনাই নয়, তৃণমূলের জমানায় শিল্পায়নের গতি রুদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে বারে বারেই আলোচনা চলছে নান মহলে। সরাসরি জামুড়িয়ার প্রসঙ্গ না এনেও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, শিল্পায়নে এ রাজ্য এগোবেই। তাঁর দাবি, “শিল্পে আমরা দেশের মধ্যে এক নম্বর হবই।”
একুশে জুলাইয়ের তারকামণ্ডিত মঞ্চ।
পাশাপাশি লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করেছেন, শিল্পায়নে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তৃণমূল সরকার সচেষ্ট। তবে তাঁর কথায়: “সিঙ্গুর স্টাইলে বা নন্দীগ্রাম মডেলে জমি অধিগ্রহণ আমরা করব না। আমাদের নীতি হল, যিনি শিল্প করতে চাইবেন, আর যিনি জমির মালিক, তাঁরা আলোচনা করে দাম ঠিক করবেন। জমির দালালি করা সরকারের কাজ নয়। কোনও শিল্পপতি শিল্প করতে চেয়েছেন বলে কৃষকের পেটে লাথি মেরে জমি নিতে হবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি না।”
দলের কর্মীদের আচরণবিধি এবং শিল্পায়ন নিয়ে আতঙ্ক কাটানোর চেষ্টার পাশাপাশি তৃণমূল নেত্রী এ দিন বার্তা দিয়েছেন বিজেপি-বিপদ মোকাবিলারও। লোকসভা ভোটে রাজ্যে এ বার দু’টি আসন জিতেছে বিজেপি। সেই ঘটনাকে কটাক্ষ করে এ দিন মমতার মন্তব্য, “এক থেকে বেড়ে দুই হয়েছে, তাতেই এত লাফালাফি, এত হইচই, এত প্রচার। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনও জায়গা নেই। পরে আর দুই থেকে তিন হবে না। আগামী দিনে ওটা দুই থেকে শূন্য হবে।”
বিজেপি-বিপদ রুখতে চেয়েই এ দিন তৃণমূল নেত্রীর আহ্বান, “বামপন্থীদের বলছি, কোনও সমস্যা থাকলে আমাদের দলে আসুন। আমরা বামপন্থীদের সম্মান করি। কিন্তু টাকার বিনিময়ে অন্য কোনও দলের কাছে আদর্শ বিকিয়ে দেবেন না।” তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, লোকসভা ভোটের ফলাফল দেখে মমতা এখন চাইছেন রাজ্যের বামবিরোধী ভোট যাতে বিজেপি-র বাক্সে না যায়। বামফ্রন্ট তাদের শক্তি খানিকটা ধরে রাখতে পারলে বামবিরোধী ভোটের ফায়দা তিনিই পাবেন। এমন ভাবনা থেকেই তৃণমূল নেত্রীর এ দিনের আহ্বান।
২১ জুলাইয়ের তারকামণ্ডিত (টলিউড, টিভি সিরিয়াল, ক্রীড়া ময়দান) মঞ্চেই এ দিন তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন কংগ্রেসের তিন বিধায়ক। তাঁরা হলেন, হাঁসন কেন্দ্রের বিধায়ক অসিত মাল, পাড়ার বিধায়ক উমাপদ বাউরি এবং গোয়ালপোখরের বিধায়ক গোলাম রব্বানি। এ ছাড়াও যোগ দিয়েছেন চন্দ্রকোনার সিপিএম বিধায়ক ছায়া দলুই। তৃণমূল নেত্রী জানিয়েছেন, নবাগতদের সঙ্গে নিয়ে একযোগে তাঁরা বাংলার মানুষের স্বার্থে কাজ করবেন। এ দিনের সমাবেশে উল্লেখযোগ্য ভাবে অনুপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল।
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।