পাশাপাশি দুটো ফ্রেম। ভোটবাক্সের সামনে তিনি। সেই ধুতি, চশমা, টাক, পাঞ্জাবির ওপর চেককাটা গলাবন্ধ কোট— কমন ম্যান, আম আদমি। ১৯৫১ সালে স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ভারতবাসীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্নভঙ্গের পর্বে কার্টুনিস্ট লক্ষ্মণের রেখায় তাঁর জন্ম। কার্টুনের সেই ফ্রেমে, যখন কমন ম্যান ভোট দিচ্ছেন, ভোটদান কেন্দ্রে, চেহারায় বেশ বড় দেখায় তাঁকে, চেনা রাজনীতির কারবারিরা তাঁর চারপাশে নিতান্তই ছোট। চোখে মুখে শারীরিক ভঙ্গিতে বিনয়। দাদাঠাকুর শরত্ পণ্ডিতের ভাষায় ‘ভোটের লাগিয়া ভিখারি’ সেজেছেন তাঁরা। ফ্রেম টু। ভোটের পর ছবি একদম বদলে গেল। বিশালকায় দানবীয় রাজনৈতিক নেতাদের পায়ের তলায় পিষে যাচ্ছেন সেই কমন ম্যান, ভোটের আগে যিনি পূজ্য ছিলেন। প্রয়াত কার্টুনিস্ট লক্ষ্মণের রেখায় এই কমন ম্যান গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন— বিচলিত, ভীত, কিন্তু দলবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদী কিংবা বিদ্রোহী নন। শুধু দেখে টাক মাথা চুলকে ওঠাই যেন তাঁর কাজ। তবে কমন ম্যান যে জোট বাঁধার কথা বিপ্লবের কথা ভাববেন না, তা তো হতে পারে না। রাজনীতি তাঁদের ক্রমাগতই বঞ্চনা করলে কত আর সহ্য করা যায়!
গত শতকের আশির দশক। অমিতাভ বচ্চন সংক্ষিপ্ত বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে ইতি টেনেছেন। ১৯৮৪-তে ইলাহাবাদে হেমবতীনন্দন বহুগুণাকে রেকর্ড ভোটে হারিয়েছিলেন অমিতাভ। তবু অ্যাংরি ইয়ং ম্যান বুঝেছিলেন এই রাজনীতির ময়দান তাঁর নয়। ১৯৮৯-তে ‘ম্যায় আজাদ হুঁ’ ছবিতে অমিতাভ আম আদমি-র ভূমিকায়। এই আম আদমির ছদ্মনাম আজাদ, সে বলে আজাদির এত বছর পরেও আম আদমির রোটি-কপড়া-মকান-এর স্বপ্ন অপূর্ণ থাকার কথা। সে এই ছবির প্রধান চরিত্র। লম্বা তাপ্পি মারা কোট পরেছে। গলায় মাফলার। কথা বলে দেহাতি হিন্দিতে। আর দলবদ্ধ হতে বলে ‘আম ইনসান’কে। মনে করিয়ে দেয় আমরা মামুলি হতে পারি কিন্তু আমরাই দল বাঁধলে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠব। আমাদের দলকে ভয় পাবে রাজনীতির কারবারিরা। আজাদের জন্য গান বেঁধেছিলেন কাইফি আজমি। সে এক আহ্বানগীতি। ইতনে বাজু ইতনে সর ইতনে বাজু ইতনে সর গিনলে দুশমন ধ্যান সে… হারেগা ও হর বাজি যব খেলে হাম জি জান সে— সাধারণ মানুষ হাতে হাত মিলিয়ে প্রাণ লড়িয়ে প্রতিবাদ করলে জনস্বার্থবিরোধী দুশমনদের পরাজয় হবেই। কাইফি আজমি সাবেকি কমিউনিস্ট, তাঁর বাঁধা গানে অপরাজেয় সাধারণ মানুষের কথা ছিল। আম আদমি ‘জগপে’ ছেয়ে যাক। তবে রাজনীতির লড়াই যে শুধু আবেগ আর আশাবাদের দাপটে জেতা যায় না এই বাস্তববোধ ম্যায় আজাদ হুঁ ছবিতে স্পষ্ট। অমিতাভের এই ছবি ১৯৪১-এর ফ্র্যাংক কাপরা’র ‘মিট জন ডো’-র আদলে তৈরি। তবে তাতে ভারতীয় গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা মিশে গিয়েছিল, আজাদ বুঝেছিল এই তাপ্পি মারা লম্বা কোট আর মাফলার পরে গান গেয়ে সে জনগণকে জাগাতে পারে, জোটবদ্ধ করতে পারে, কিন্তু তার পর জনস্বার্থরক্ষার স্থায়ী পদ্ধতি ও রাজনৈতিক প্রকরণ কী হবে তার খোঁজ দিতে পারে না।
তবু ‘স্টুপিড কমন ম্যান’ নানা ভাবে খোঁজ চালায়। ২০০৮-এ নীরজ পাণ্ডের ছবি ‘আ ওয়েনেসডে’-তে নাসিরুদ্দিন সেটাই করেছেন। নাসিরুদ্দিনের বক্তব্য, আপনার ঘরে যদি ছুঁচো-আরশোলা ঢুকে পড়ে তা হলে কদ্দিন আর বসে থাকবেন! সাফ করার কাজটা তো নিজেকেই ঝাঁটা হাতে করতে হবে। ছবিটি দক্ষিণ ভারতের একাধিক ভাষায় রূপান্তরিত— কমল হাসান, মোহনলাল এই কথা দক্ষিণ ভারতেও পৌঁছে দিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কার ছবি করিয়ে চন্দ্রন রত্নম এই ছবি থেকে বানিয়েছিলেন ‘আ কমন ম্যান’ (২০১৩)। শুধু আমাদের দেশেই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতেই কমন ম্যান-এর ভাবনা গুরুতর হয়ে উঠছে।
কিন্তু গত পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে আমাদের ভাবনায় এই যে কমন ম্যান-এর প্রসঙ্গ উঠে আসছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটা বিষয় লক্ষ করার মতো— স্থায়ী উন্নয়ন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সেই সাধারণ মানুষ-এর ভূমিকা ঠিক কী হবে তার রূপরেখা কোথাও নেই। অমিতাভের ছবিতে ছিল না, নাসিরুদ্দিনের ছবিতেও না। নাসিরুদ্দিন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বোমা বানিয়েছেন। বোমা বানানোর পদ্ধতি নেট সার্ফ করে না হয় পাওয়া গেল! কিছু ফাটানো হল! তাতে কী! স্বদেশি আমল থেকেই তো অনেকেই এই বোমা ফাটানোর রোমাঞ্চে আন্দোলিত হয়েছেন, তাতে জনগণের সমস্যা মেটেনি। রোমাঞ্চ উন্নয়ন নয়।
অতঃপর ‘আম আদমি পার্টি’। বিপুল ভোটে জয় লাভ করে দিল্লিতে তার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে। শুধু আবেগ আর নাটক দিয়ে যে রাজনীতি চলে না, প্রথম ইনিংসে আপ তা বুঝেছে। দ্বিতীয় ইনিংসে আপ বিপুল ভোটে জিতে কেন ফিরল? একটা কারণ বিগত কয়েক মাসে মোদী আর চায়েওয়ালা মোদী নেই। সাধারণ মানুষ এই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিজেকে আর একাত্ম করতে পারেন না— চায়েওয়ালার সঙ্গে খানিকটা পারতেন, মোদী-কোটের সঙ্গে পারেন না। অন্য দিকে মাফলার পরা কেজরীর সঙ্গে আম আদমির একাত্মতা তৈরি হয়। কংগ্রেসের শূন্যতা, ‘চা-ওয়ালা মোদী’র কোট পরা মোদী হয়ে ওঠা: এই দুই ঘটনা কেজরী ও তাঁর আপ-কে দিল্লির মসনদ দিয়েছে। এর পরের কাজটা কিন্তু সবচেয়ে শক্ত। আম আদমি আর আম আদমি পার্টি এক নয়। আম আদমি পার্টি আর সরকারও এক নয়। কাজেই আম আদমির আবেগ ও নাটক নিয়ে পার্টি চলে না, সরকারও নয়।
গণতন্ত্রে জয়লাভ, বিপ্লবের জয়, এ সবই মুহূর্তবিশেষ। গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগঘন। মুহূর্ত দ্রুত অতিক্রান্ত হয়। তখন কর্মসূচির প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ উঠে আসে। এ ক্ষেত্রেও আসবে। কেজরী কী করেন, দেখার। খুবই কঠিন সে সাধনা। একই সঙ্গে তাঁকে আম আদমি থাকতে হবে ও প্রশাসক হয়ে উঠতে হবে। প্রশাসক হয়ে ওঠার কিছু কিছু লক্ষণ কেজরী তাঁর কথায় দেখাচ্ছেন। রাজনীতির ময়দানে প্রশাসক হিসেবে অপরাপর দলের সঙ্গে সৌজন্য যে বজায় রাখতে হয় আর সেই সৌজন্য প্রদর্শন মানেই যে বোঝাপড়া নয়, এই সহজ কথা কেজরীর আচরণে প্রকাশিত। ধরে নেওয়া যায় তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস প্রথম ইনিংসের মতো হঠাত্ সংক্ষিপ্ত হয়ে যাবে না। তবে যথার্থ জনস্বার্থ রক্ষাকারী কর্মসূচির যথাযথ নির্মাণ প্রয়োগ না ঘটালে কিছুই হবে না। কমন ম্যান কেজরী প্রশাসক কেজরী হয়ে কী ভাবে তা করেন উপমহাদেশের আম আদমি তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক